ব্ল্যাক হোল বর্তমানে বারবার বিভিন্ন খবরে চলে আসছে কেননা প্রতিদিন আমরা এ নিয়ে নতুন কিছু জানছি। ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ বা ইএইচটি একটি ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। এরপর ২০২২ সালের মে মাসে এই টেলিস্কোপ আমাদের মিল্কি ওয়েতে থাকা ‘স্যাজিটারিয়াস এ’ নামের একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের ছবি তুলতে সক্ষম হয়।
ব্ল্যাকহোল নিয়ে আমরা এই আধুনিক যুগে এসে অনেক কিছু জানতে পারলেও এখনও ব্ল্যাক হোল নিয়ে অনেক রহস্যই আমাদের অজানা রয়ে গেছে। বিভিন্ন মুভি, সিরিজ, সায়েন্স ফিকশনের কল্যাণে ব্ল্যাক হোল নিয়ে বেশ অনেক কিছুই আমরা জানি। তবে একারণে সহজেই ব্ল্যাকহোল নিয়ে কিছু ভুল ধারণাও আমাদের মাঝে তৈরি হয়ে গিয়েছে।
আমরা অনেকেই মনে করি ব্ল্যাক হোল মহাকাশে ভ্রমণ করে সামনে যা পায় সেটাই ভক্ষণ করতে থাকে (বা নিজের মধ্যে টেনে গিলে ফেলে) অনেকটা ভয়ানক কোনো রাক্ষসের মতো। কিন্তু বাস্তবে ব্ল্যাক হোল আসলে তেমন নয়। ব্ল্যাক হোল খালি চোখে দৃশ্যমান নয় এবং তারা সময়কে ধীর করে দিতে সক্ষম। ব্ল্যাকহোল মহাকাশের ধূলাবালি সব ভক্ষণ করতে করতেও এগিয়ে চলে না।
এর কারণ খুবই সাধারণ। পৃথিবী এবং মহাকাশের আর সকল কিছুর মতোই ব্ল্যাকহোলের মধ্যে থাকে অভিকর্ষজ টান। এই অভিকর্ষ বলের কারণেই চাইলেই যে কোনো গ্রহ এই ব্ল্যাকহোলের চারপাশে ঘুরতে পারে যেমনটা পৃথিবী ঘুরছে সূর্যের চারদিকে এবং চাঁদ ঘুরছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে। ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার থেকে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সে ডক্টরেট করা অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট ডক্টর ক্রিশ্চিনা স্মিথের মতে, যদি সূর্য হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে সেখানে তার সমান ভরের একটি ব্ল্যাক হোল চলে আসে তবুও পৃথিবী সেই ব্ল্যাকহোলের মাঝে চলে যাবে না। বরং পৃথিবী এমনভাবে এর চারদিকে ঘুরতে থাকবে যেন কোনোকিছু পরিবর্তন হয়নি!
ব্ল্যাকহোল সবকিছু নিজের ভেতরে টেনে নেয় না! (অন্তত যেভাবে অনেকে মনে করে সেভাবে না)
যদি আরও একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয় তবে দেখা যাবে যে, যদি পৃথিবীর বদলে সমান ভরের একটি ব্ল্যাক হোল দেয়া হয় তবে সেই ব্ল্যাক হোল কখনোই পৃথিবীর সমান জায়গা দখল করবে না। বরং মাত্র দুই সেন্টিমিটার ডায়ামিটারের জায়গা এটি দখল করবে। এই ব্ল্যাক স্পিয়ারকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন। ইভেন্ট হরাইজন হলো তাত্ত্বিকভাবে ব্ল্যাকহোলের মধ্যে এমন একটি স্থান যেখান থেকে কোনো কিছুই বের হতে পারে না, এমনকি কোনো আলোও নয়। অর্থাৎ এই জায়গাতে সকল কিছুই ব্লাক হোলের মধ্যে আটকা পরে যায়। এই অংশকে বলা হয় পুরো মহাবিশ্বের মধ্যে সবথেকে ঘনত্বপূর্ণ বস্তু।
তবে ফোর্বসের তথ্য মতে ব্ল্যাকহোলের চারপাশের এই স্পেস (“curvature of space”) প্রায় পৃথিবীর মতোই সমান হবে। তাই যেসব বস্তু একদম পৃথিবীর কাছ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারতো সেগুলো এই ব্ল্যাকহোল টেনে নিতে পারতো না। আর যেসব বস্তু একদম পৃথিবীকে আঘাত করতো সেগুলো এই ব্ল্যাকহোলকে পুরোপুরি এড়িয়ে যেতো কেননা তাকে একদম ২ সেন্টিমিটার ডায়ামিটারের মধ্যে ইভেন্ট হরাইজন পয়েন্টে আসতে হতো ব্ল্যাক হোলের মাঝে আটকা পড়তে।
ভর হচ্ছে ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে মূল বিষয়। কেননা প্রতিটি ব্ল্যাক হোলের মাঝে থাকে একটি সিঙ্গুলারিটি বা একদম ক্ষুদ্র একটি অংশ যা অনেক ঘনত্বপূর্ণ ভর দ্বারা পূর্ণ থাকে। আমরা জানি একটি বস্তুর অভিকর্ষ টান বা বল ততো বেশি হয় যত বেশি হয় সেই বস্তুর ভর। যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বস্তু এই ইভেন্ট হরাইজন সীমানার থেকে দূরে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি ব্ল্যাক হোলের মাঝে আটকা পড়বে না। তবে বস্তুটি এই অংশের যত কাছে চলে আসবে, বাঁচতে চাইলে তত তাড়াতাড়ি সেই বস্তুকে দূরে সরে যেতে হবে। তবে বস্তুটি যদি ইভেন্ট হরাইজনের সীমানার মধ্যে ঢুকে পড়ে তবে তার পক্ষে আর বের হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
অর্থাৎ ব্ল্যাক হোল যে তার চারপাশের সকল বস্তুকে টেনে নেবে ব্যাপারটি এমন নয়। কোনো বস্তুর ব্ল্যাক হোলের মধ্যে আটকা পড়তে তাকে অবশ্যই ইভেন্ট হরাইজন সীমানার মধ্যে প্রবেশ করতে হবে, তবেই শুধুমাত্র সেই বস্তু আটকা পড়বে ব্ল্যাকহোলের মাঝে। কাজেই মুভি দেখে বা বই পড়ে আপনি ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে যে ব্যাপারটি কল্পনা করেছেন সেটি ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি!
0 responses on "ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে ভুল ধারণা ও সঠিক তথ্য জেনে নিন"