যারা এডভেঞ্চার পছন্দ করেন তাদের কাছে স্কাইডাইভিং বেশ রোমাঞ্চকর একটি অভিজ্ঞতা। সাধারনত ১০,০০০ ফিট উপর থেকে লাফ দিলে সেটাকে স্কাইডাইভিং বলা হয়। কিন্তু ১০ বছর আগে ফেলিক্স বমগার্টনার যেটি করেছিলেন তা শুনলে আপনার হৃদয় কেঁপে ওঠাটাই স্বাভাবিক। তিনি মহাশূন্যের দ্বারপ্রান্ত (edge of space) হতে, পৃথিবী থেকে প্রায় ১২৭,৮৫২ ফিট বা ৩৮,৯৬৯.৪ মিটার উপর হতে পৃথিবীতে লাফ দিয়েছিলেন।
ফেলিক্স বমগার্টনার একজন অস্ট্রিয়ান স্কাইডাইভার যিনি ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর এই দুঃসাহসিক লাফটি ইউটিউবে স্ট্রিম করেছিলেন এবং সে সময় ৮টি বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন। তিনি এই লাফে শব্দের থেকেও বেশি গতিতে নিচে নেমেছিলেন যা ছিল অভাবনীয় একটি বিষয়।
এই দুঃসাহসিক লাফটি দেবার জন্য ফেলিক্সের অনুপ্রেরণা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ক্যাপ্টেন জো কিটিংগার যিনি ১৯৬০ সালে ১০২,৮০০ ফিট হতে লাফ দিয়েছিলেন। মাত্র ৩৩ বার লাফ দেবার অভিজ্ঞতা নিয়েই এই কাজটি করেছিলেন জো কিটিংগার। ফেলিক্স বমগার্টনার তার এই লাফটি দেবার আগেই হাজারবারেরও বেশি লাফ দেওয়া অভিজ্ঞ একজন স্কাইডাইভার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিলো এই লাফে শব্দের থেকেও বেশি গতি অর্জন করা। আর তাতে তিনি ছিলেন পুরোপুরি সফল।
‘রেডবুল স্ট্রাটোস প্রজেক্ট’ নামের প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার ও ৫ বছরের পরিকল্পনায় এই স্কাইডাইভিং সফল হয়েছিলো। এর মাধ্যমে চরম অবস্থায় মানুষের শরীর কতটুকু টিকে থাকতে পারে সে সম্পর্কে নতুন ধারণা পাওয়া যায়। এই স্কাইডাইভিংয়ের পরিকল্পনায় অনেক রকম ঝুঁকি মাথায় রাখতে হয়েছিলো সংশ্লিষ্ট সকলের। ফেলিক্সের জন্য আলাদা প্রেসার স্যুট বানানো হয়েছিলো যা পাইলটরা পড়ে থাকেন।
অতিরিক্ত গতির ফলে প্রেসার স্যুট ছাড়া মানুষের রক্ত ফুটতে শুরু করতে পারে। তাই যদি এই প্রেসার স্যুটে কোনরকম সমস্যা হতো তাহলে মাত্র ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে ফেলিক্সের মৃত্যু হতে পারতো। এছাড়া প্যারাসুটে সমস্যা দেখা দেয়ার ঝুঁকিও ছিল। ফেলিক্সকে মহাশূন্যের শেষ প্রান্তে নিয়ে যেতে আলাদাভাবে একটি হিলিয়াম বেলুন ডিজাইন করতে হয়েছিলো।
২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর ফেলিক্স বমগার্টনার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো হতে যাত্রা শুরু করেন। ৯০ মিনিট উপরে উঠবার পর ১২৭,৮৫২ ফিট বা ৩৮,৯৬৯.৪ মিটার উপর হতে তিনি লাফ দিতে প্রস্তুত হন। লাফ দেবার পর তিনি মাত্র ৫০ সেকেন্ডের মাথায় ৮৪৩ এমপি/এইচ বা ১৩৫৭.৬ কিমি/এইচ গতি অর্জন করেন যা শব্দের বেগের (৭৬৭ এমপি/এইচ) থেকেও বেশি। তিনি প্রায় ৪ মিনিট ৩০ সেকেন্ড ধরে নিচে পড়তে থাকেন মাটি ছোবার আগ পর্যন্ত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৪২১.৩ ফিট বা ২৫৬৬.৮ মিটার উচ্চতায় তিনি তার প্যারাসুট খোলেন এবং মাটিতে পা রাখেন।
এই লাফে তিনি ৮ টি বিশ্বরেকর্ড ভেঙ্গে দেন। মুক্ত পতনে শব্দের থেকেও বেশি গতি অর্জন করা প্রথম মানুষ তিনি। এছাড়া সেসময় সবথেকে বেশি উচ্চতা হতে প্যারাসুট দিয়ে লাফ দেয়ার রেকর্ডও তিনি ভাঙ্গেন। যদিও এই রেকর্ড বেশিদিন টিকে থাকে নি। দুই বছর পর ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালান ইউস্টাস ১৩৫,৮৯৮ ফিট বা ৪১,৪২২ মিটার উচ্চতা হতে লাফ দিয়ে এই রেকর্ড ভেঙ্গে দেন।
৭৭ টি টিভি চ্যানেল একসাথে তার এই দুঃসাহসিক লাফের দৃশ্যটি লাইভ দেখিয়েছিলো। তিনি সেসময় ইউটিউবে লাইভ স্ট্রিম হওয়া ভিডিওর মধ্যে সবথেকে বেশি ভিউ পাওয়ার রেকর্ডও গড়ে ফেলেছিলেন। পুরো দৃশ্যটি ১৫ টি ক্যামেরার মাধ্যমে ধারন করা হয়েছিলো যার মধ্যে ৫টি তার স্যুটের মধ্যেই সংযুক্ত ছিল।
বর্তমানে ফেলিক্স একজন অ্যাক্রোব্যাটিক হেলিকপ্টার পাইলট এবং দমকল কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের সেবায়। তিনি এরকম দুঃসাহসিক কাজ করতে চান না আর। এটি তিনি পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছেন বলে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ডেইলিমেইলকে। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডভুক্ত এরকম দুঃসাহসিক স্কাইডাইভিং থেকে তিনি প্রমাণ করেছেন মানুষ তার সাহস ও মনোবল দিয়ে অস্বাভাবিক অনেক কাজ করে ফেলতে পারে। তিনি তারুণ্যের জন্য হয়ে উঠেছেন এক অনুপ্রেরণার নাম।
0 responses on "মহাশূন্য থেকে পৃথিবীতে লাফ দিয়েছিলেন যিনি – ফেলিক্স বমগার্টনার"