বর্তমান সময়ে যেকোনো বয়সের মানুষই সোশ্যাল মিডিয়াতে একাউন্ট খুলে থাকেন। মূলত পরিচিত ব্যক্তিদের পাশাপাশি সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে আপ টু ডেট থাকার জন্যই অধিকাংশ মানুষ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন। এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মগুলোর মধ্যে ফেসবুক একাউন্ট সর্বাধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কেননা ফেসবুক মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখার সুবিধা প্রদানের পাশাপাশি বিনোদন মূলক কন্টেন্ট দেখার বিকল্প অপশন দিয়ে থাকে।
কিন্তু ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্ম যদি আপনি সতর্কতার সাথে ব্যবহার না করেন তাহলে এর পরিনাম অত্যন্ত ভয়ানক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি একজন হ্যাকার আপনার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে লোক ঠকানোর থেকে শুরু করে আপনার ব্যাংক একাউন্ট পর্যন্ত খালি করে দিতে পারে।
আমাদের আর্টিকেলে আমরা ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হবার কারণ সম্পর্কে এবং হ্যাকারের হাত থেকে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট কিভাবে সুরক্ষিত রাখবেন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ফেসবুক হ্যাক হবার কয়েকটি সাধারণ কারন
ফিশিং
এক জরিপ মতে জানা যায় যে বেশিরভাগ ফেসবুক একাউন্ট ফিশিং পদ্ধতি অবলম্বন করে হ্যাক করা হয়। ফিশিং টেকনিকের মাধ্যমে হ্যাকার প্রথমে ফেসবুকের হোমপেজের অনুরূপ দেখতে একটি নকল ওয়েব পোর্টাল তৈরি করে। তারপর আপনাকে লগ ইন করতে বলে ইমেইল পাঠায়। আপনি যখন ওই পাঠানো লিংক এ ক্লিক করে আপনার ইমেইল আইডি ও পাসওয়ার্ড প্রবেশ করিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করার চেষ্টা করবেন তখন আপনার যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য বিস্তারিত আকারে সেই সকল অসাধু হ্যাকারদের কাছে চলে যাবে। হ্যাকাররা এই সকল তথ্য ব্যবহার করে খুব সহজেই আপনার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করে ফেলতে পারে।
স্টোর্ড পাসওয়ার্ড
মোবাইল ফোন হোক কিংবা ল্যাপটপ আপনি যেই ডিভাইস থেকেই ফেসবুক একাউন্টে লগ ইন করতে চান না কেন সেই ডিভাইসটি লগ ইন করার সময় আপনার পাসওয়ার্ড সেভ বা সংরক্ষন করার অনুমতি চায়। আপনি খুব দ্রুত লগ ইন করার জন্য সাধারণত এই ফিচারটির সেবা গ্রহন করে থাকেন। কিন্তু আপনি হয়তো জানেন না যে আপনি নিজের একাউন্টের নিরাপত্তা জনিত সংকট দেখা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। কেউ যদি আপনার পাসওয়ার্ড ম্যানেজার হ্যাক করে নিতে সক্ষম হয় তাহলে ডিভাইসে সংরক্ষিত যাবতীয় তথ্য সেই অসাধু ব্যক্তির হাতের নাগালে চলে যাবে। শুধু এটাই নয়, হ্যাকাররা চাইলে সেই সকল তথ্য ব্যবহার করে আপনার ফেসবুক একাউন্টে প্রবেশ করে বিভিন্ন প্রকার অবাঞ্চনীয় কাজকর্ম ও করতে পারে।
কী লগিং
এটি হলো একটি বিপজ্জনক ভাইরাস, যা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ফোল্ডারে এমন ভাবে লুকিয়ে থাকে যে একজন প্রযুক্তি সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তিও অনেক সময় তা শনাক্ত করতে পারেন না। কী লগার প্রোগ্রাম যদি আপনার কম্পিউটার, ট্যাবলেট বা মোবাইলে ইন্সটল হয়ে যায় তবে আপনি সে ডিভাইসে যাই টাইপ করেন না কেন সেটি অটোমেটিকালি তারা রেকর্ড করে নিবে। আর পরবর্তীতে সমস্ত তথ্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় হ্যাকারদের কাছে।
এক্ষেত্রে চুরি হওয়া তথ্যের মধ্যে ফেসবুক সহ যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া পাসওয়ার্ড, ব্যাংকিং বিষদাবলী এবং অন্যান্য গোপনীয় তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ফলে কী লগিং এটাকের মাধ্যমে পাওয়া যাবতীয় তথ্য ব্যবহার করে একজন হ্যাকার খুব সহজেই আপনার পরিচয় চুরি করে অসৎ কাজে লিপ্ত হতে পারে।
সাইডজ্যাকিং
বিনামূল্যে ইন্টারনেট কানেকশন পেলে কে না খুশি হয়। কিন্তু সাময়িক এই খুশি আপনার পরবর্তী দিনগুলোকে বেদনাদায়ক করে দিতে পারে। কেননা রেস্তরা, শপিং মল বা রেল স্টেশন জাতীয় কোনো জায়গার পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করার মাধ্যমে আপনি সাইডজ্যাকিং এর কবলে পড়ে যেতে পারেন। সাইডজ্যাকিং এটাকে হ্যাকার একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে আপনার ডিভাইস এক্সেস চুরি করে থাকে।
এই ব্রিচ হ্যাকারকে ডিভাইস হ্যাক করার সময়ে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে আপনার ছদ্মবেশ ধারণ করার অনুমতি দিয়ে থাকে। এই ধরনের হ্যাকিংকে সেশন হাউজ্যাকিং বা কুকি হ্যাইজ্যাকিং নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাই পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ফেসবুক বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে লগইন না করাই ভালো। কারণ করলে সাইডজ্যাকিং এর ফাঁদে পড়ে যেতে পারেন।
ফেসবুকে নিরাপদ থাকার উপায়
আপনার ফেসবুক একাউন্ট নিরাপদ রাখার জন্য আপনি নিচে বর্ণিত কার্যকর উপায়গুলো অবলম্বন করতে পারেন।
একাউন্টের লগ ইন তথ্য শেয়ার করবেন না
সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে ব্যবহৃত ইমেইল আইডি বা পাসওয়ার্ড কখনোই কারোর কাছে প্রকাশ করবেন না। এছাড়া নিজের ডিভাইস ব্যতীত অন্য কারো ডিভাইসে কখনো ফেসবুক পরিচালনা করা থেকে বিরত থাকুন। যদি একান্তই অন্যের মোবাইল বা ল্যাপটপে লগ ইন করার প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই বিস্বস্ত কারো ডিভাইস ব্যবহার করুন।
অনন্য পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন
আমরা অনেক সময় জনবহুল কোন জায়গায় নিজেদের মোবাইল থেকে ফেসবুকে লগইন করে থাকি। এটি আসলে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা কিন্তু একটু অসতর্কতার জন্য অনেক সময় অঘটন ঘটে যেতে পারে। কেননা আমাদের আশেপাশে থাকা অপরিচিত ব্যক্তিরা আমাদের গতিবিধির উপর নজর রাখতে পারে। তাদের মূল উদ্দেশ্যই হলো সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের পাসওয়ার্ড চুরি করা। তাই এমন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন যেটা অনুমান করার অযোগ্য। এছাড়া আপনার পছন্দনীয় কোনো নাম্বার, প্রিয় মানুষের নাম কিংবা আপনার জন্ম তারিখ পাসওয়ার্ড হিসেবে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। সব সময় একটি অনন্য পাসওয়ার্ড দেয়ার চেষ্টা করুন। এছাড়া পাসওয়ার্ড প্রবেশ করানোর সময় ফোনটিকে আড়াল করে নিতে পারেন।
ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করার সময় সতর্ক থাকুন
ফেসবুকে শুধুমাত্র এমন ব্যক্তিদের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করুন যাদের আপনি বাস্তব জীবনে চেনেন। কেননা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন্ধু সেজে আপনার প্রোফাইলে প্রবেশ করে হ্যাকাররা আপনার দেওয়া ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার করে অসৎকর্মে লিপ্ত হতে পারে। (যেমন আপনি সেজে টাকা ধার করা ইত্যাদি।) তাই পরিচিত মানুষ ব্যতীত অন্যদের রিকোয়েস্ট এক্সসেপ্ট না করাই ভালো। এতে আপনার ফেসবুক একাউন্ট সুরক্ষিত থাকবে।
লিংক ক্লিক করাকালীন সতর্ক থাকুন
ফেসবুকের ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা কোন অপরিচিত বা পরিচিত ব্যক্তি যদি আপনাকে কোন লিংক পাঠায় তবে তাতে ক্লিক করার আগে অবশ্যই সতর্ক হয়ে নিন। লিংকটি যথাযথ কিনা সে ব্যাপারে যাচাই করে নিন। হ্যাকাররা ফিশিং লিংক প্রেরণের মাধ্যমে আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার চেষ্টা করতে পারে।
মোবাইল যেখানে সেখানে ফেলে রাখবেন না
যত্রতত্র মোবাইল বা ল্যাপটপ এর মত গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস ফেলে রাখবেন না। বিশেষত আপনি যদি নিজের ডিভাইসে কোনো পাসওয়ার্ড ব্যবহার না করেন তবে আরো সতর্ক থাকা উচিত। কেননা আপনার অবর্তমানে কোনো অপরিচিত ব্যক্তি ডিভাইসে সংরক্ষিত তথ্য চুরি করে নিতে পারে। আর তারপর ফেসবুকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট হ্যাক করা এমন কোনো কঠিন কাজ হবে না।
পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন
ভুলেও পাবলিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ফেসবুকে লগ ইন করবেন না। কেননা ক্যাফে বা শপিং মলের ফ্রী ওয়াইফাই করার জন্য আপনার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টসহ ফোনে থাকা বাদ বাকি তথ্যাদিও হ্যাকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে। কেননা পাবলিক নেটওয়ার্ক এ একসাথে অনেক ব্যবহারকারী থাকে। ফলে কেউ যদি পাবলিক নেটওয়ার্ক সিস্টেমে ম্যালাশিয়াস কোড ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়ে যায় তাহলে সেই ওয়াইফাই ব্যবহারকারী সকল ডিভাইস হ্যাক হয়ে যেতে পারে।
টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন
আপনার ফেসবুক একাউন্টের সিকিউরিটি এন্ড লগ ইন সেটিংস এর পেজে দেখতে পাবেন ফেসবুক টু ফ্যাক্টর অথেন্টিকেশন নামের একটি অপশন। এই অপশনটি অবশ্যই চালু রাখতে হবে। এতে করে যখন আপনার ফেসবুক একাউন্টে নতুন কোন ডিভাইস থেকে লগইন করার চেষ্টা করা হবে, তখন আপনার অ্যাকাউন্টের সাথে সংযুক্ত মোবাইল নাম্বারের মধ্যে একটি ভেরিফিকেশন কোড চলে আসবে। আর এই কোড ছাড়া কেও আপনার ফেসবুক একাউন্টে কখনোই লগ ইন করতে পারবেন না।
একটি মানুষের ফেসবুক একাউন্ট তার জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে থাকে। তাই এই একাউন্ট হ্যাক হয়ে গেলে সেটি তার জীবনে অনেক বাজে অভিজ্ঞতার সৃষ্টি করবে। ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হওয়া সম্পর্কে আমাদের এই আর্টিকেলটি আপনাদের কেমন লেগেছে তা আমাদের কমেন্ট করে জানাতে পারবেন। নিত্য নতুন টেকনোলজি বিষয়ক নানা ধরনের তথ্য এবং টিপস পেতে চোখ রাখুন আমাদের এই ওয়েবসাইটে।
0 responses on "ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হবার কারণ এবং এর থেকে বাঁচার উপায়"