
ন্যানো টেকনোলজি আধুনিক সময়ের একটি বিস্ময়ের নাম। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কয়েক দশকের মধ্যেই এতো অভাবনীয় উন্নতি সম্ভব হয়েছে ন্যানো টেকনোলজির কারণেই। প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখলে ন্যানো টেকনোলজির নাম অনেক শুনে থাকবেন। কিন্তু ন্যানো টেকনোলজি আসলে কী এ নিয়ে আমাদের অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই।
ন্যানো টেকনোলজির সাধারণ মানে হচ্ছে কোন পদার্থকে অণু বা পরমাণুর কাছে গিয়ে নিয়ন্ত্রন করা। অর্থাৎ খালি চোখে দেখা যায় না এমন অবস্থায় থাকা পদার্থকেও আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম। শুনতে কল্পকাহিনীর মতো মনে হলেও আধুনিক বিজ্ঞান একে সম্ভব করেছে। এই পোস্ট ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক কিছু সম্পর্কেই আলোচনা করবো আমরা। সেই সাথে জেনে নেব এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ন্যানো টেকনোলজি কীভাবে বিভিন্ন আবিষ্কারে আমাদের সাহায্য করছে।
ন্যানো টেকনোলজি কী?
অণু ও পরমাণু আমাদের চারদিকের সকল বস্তুজগত তৈরি করেছে। কিছুদিন আগেও অণু বা পরমাণুকে নিয়ন্ত্রন করার কথা চিন্তাও করা যেত না। তবে আধুনিক বিজ্ঞান সেই অসম্ভবকেই সম্ভব করেছে। মানুষ এখন অনু বা পরমানুকেও নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম। অনু বা পরমানুকে নিয়ন্ত্রন করে নতুন জিনিস তৈরি করাও সম্ভব হয়ে উঠেছে এখন। আমরা যেভাবে দালান বানাই ইট গেঁথে অনেকটা তেমন ভাবেই ন্যানো টেকনোলজি কাজ করে থাকে। উক্ত নির্মাণ একেবারেই ক্ষুদ্র আকারে সংগঠিত হয় বলে তা খালি চোখে দেখা যায় না। মাইক্রোস্কোপেরও ১০০০ গুন ছোট অবস্থায় সংগঠিত হয় সেসব।
ন্যানো টেকনোলজির জগতকে আবিষ্কার করার ফলে আসলে আমাদের কী উপকার হয়েছে এমন প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। আসলে কোন বস্তুকে খালি চোখে দেখে যেমনটা মনে হয় তা জুম করে একদম মাইক্রোস্কোপে দেখলে দেখা যাবে কোনটাই আসলে তেমন নয়। যে কোন বস্তু সম্পর্কে অনেক নতুন জিনিস জেনে নেয়া সম্ভব তা এতো ছোট অবস্থায় দেখার ফলে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার ফলে অনেক সমস্যারই সমাধান পাওয়া সম্ভব ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে।
আধুনিক যুগে প্রযুক্তি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন অনেক কিছুতেই ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার হচ্ছে। আমরা অনেক সময় এই ব্যাপারে না জেনেই এগুলো ব্যবহার করছি। যেমন আমাদের ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে ন্যানো টেকনোলজির গুনে। অনেক বেশি শক্তির প্রসেসিং পাওয়ার মোবাইলের মতো ছোট ডিভাইসে দেয়া সম্ভব হচ্ছে এই ন্যানো টেকনোলজির ফলে। এছাড়াও দৈনন্দিন আরও অনেক জায়গায় আমরা ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার হতে দেখছি।
ন্যানো টেকনোলজি কোথায় ব্যবহৃত হচ্ছে
আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের অনেক জিনিসেই আছে ন্যানো টেকনোলজির অবদান। এখন আমরা এমন বেশ কিছু জিনিস নিয়ে জানবো যেখানে নিয়মিত ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার হচ্ছে।
- সানস্ক্রিন: ন্যানো পার্টিকেল নিয়মিত ব্যবহার করা হয়ে থাকে সানস্ক্রিনে যা আমরা ব্যবহার করি। ন্যানো পার্টিকেল আছে অনেক ধরনের। সানস্ক্রিনে মূলত টাইটেনিয়াম ডাইঅক্সাইড এবং জিংক অক্সাইডের ব্যবহার হয়ে থাকে। এরা সূর্যের আলো থেকে আসা শক্তিশালী আল্ট্রাভায়োলেট রশ্নিকে আটকাতে বেশ কার্যকর। এছাড়া এই ন্যানো পার্টিকেল দুটি বেশ হালকা বলে স্ক্রিনে আগের যুগের সানস্ক্রিনের মতো মোটা করে মাখতে হয় না। আধুনিক সানস্ক্রিন তাই সাধারণ ক্রিমের মতোই কাজ করে।
- কাপড়: কাপড়ে আজকাল নিয়মিত ন্যানো পার্টিকেলের ব্যবহার হচ্ছে। মূলত কাপড়কে পানিরোধী করতে ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার করা হয়। সিলিকা নামক বস্তু সাধারণ কাপড়ের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এর ফলে তরল যে কোনো বস্তু আর কাপড়ে লেগে যায় না। রেইন কোট বা পানি নিরোধক কাপড়ের ব্যাগে আমরা এর ব্যবহার নিয়মিত দেখতে পাই।
- আসবাবপত্র: কাপড়ের মতো করেই আসবাবপত্রের উপরে ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে আলাদা একটি প্রলেপ দিয়ে তাকে পানিরোধী করা হয়। এছাড়া এতে করে আসবাবপত্র বেশিদিন টেকসই হয়ে থাকে। ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে আসবাবপত্রকে ৩৫% পর্যন্ত কম দাহ্য করা সম্ভব। ফলে সহজে তাতে আগুন ধরতে পারে না।
- আঠা: সাধারণত আমাদের ব্যবহার করা সাধারণ সব আঠাই অধিক তাপে নষ্ট হয়ে যায়। তবে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে এক ধরনের বিশেষ আঠা এখন তৈরি করা হয় যা তাপে আরও শক্তিশালী হয়। একে ‘ন্যানো-গ্লু’ বলা হয়ে থাকে।
- টেনিস বল: খেলাধুলার বিভিন্ন সরঞ্জামে নিয়মিত ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহার হয়। সবথেকে বেশি যেখানে এটি ব্যবহার হয় সেটি হচ্ছে টেনিস বলে। টেনিস বলগুলোতে লম্বা সময় লাফানোর ক্ষমতা দিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া টেনিস রেকেটের নেটকেও শক্তিশালী করতে এটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
- কম্পিউটার: ন্যানো টেকনোলজি সবথেকে বড় অবদান রেখেছে কম্পিউটারের ক্ষেত্রে। একদম ছোট কম্পিউটারের প্রসেসরের মধ্যেই অকল্পনীয় এই শক্তি দেয়া সম্ভব হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজির জন্যই। তৈরি হচ্ছে অনেক স্মার্ট ডিভাইস যা আগে কখনও ভাবাও যেত না। চিপের দুনিয়ায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে ন্যানো টেক।
উপরের বিষয়গুলো শুধু আমাদের চারপাশে নিয়মিত দেখা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজির অবদান। এছাড়াও হাজার হাজার ক্ষেত্রে ন্যানো টেকনোলজি অবদান রেখে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সেবায় আধুনিক সকল যন্ত্র ন্যানো টেকের ব্যবহারেই তৈরি হচ্ছে। ওষুধ তৈরির ক্ষেত্রেও আজ ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহার হচ্ছে। পানি পরিষ্কারের ক্ষেত্রে আধুনিক ফিল্টারগুলো ব্যবহার করছে ন্যানো টেক। প্লাস্টিক বোতল তৈরিতে ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহারে বেশিদিন ভালো থাকছে বোতলগুলো। এছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি আজ ব্যবহার হচ্ছে যা বলে শেষ করা কঠিন।
ন্যানো টেকনোলজির গুরুত্ব বোঝা সম্ভব আমাদের নতুন প্রজন্মের স্মার্ট টিভি, ঘড়ি, ফ্রিজ, ওভেন বা হোম থিয়েটারের মতো বিভিন্ন জিনিসের দিকে লক্ষ্য করলেই। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ন্যানো টেকনোলজির বিকল্প নেই। প্রতি বছর নতুন নতুন শক্তিশালী চিপ ডিজাইনের মাধ্যমে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা এনে দিয়েছে এটি। অনেকের মধ্যেই আধুনিক মানব সভ্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজি। আধুনিক সভ্যতার সকল কিছুকেই ছুঁয়ে গেছে এই প্রযুক্তি। প্রভাব ফেলছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে। আবহাওয়া, দুর্যোগ ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যার সমাধানও আজ খোঁজা হচ্ছে এই প্রযুক্তির মাঝে।
বেশিরভাগ মানুষ ন্যানো টেকনোলজির অবদান নিয়ে এখনও সচেতন নয়। তাছাড়া ন্যানো টেকনোলজির আধুনিক বিভিন্ন ব্যবহার এখনও পুরোপুরি প্রচলিত হয় নি। মানুষকে এই ব্যাপারে আরও বেশি সচেতন করার মাধ্যমে ন্যানো টেকনোলজি থেকে আরও অনেক বেশি সুবিধা পাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি যাতে সবাই ব্যবহার করতে পরে এমন অবস্থায় নিয়ে আসা জরুরি। তাই ন্যানো টেকনোলজির গুরুত্ব বোঝার মাধ্যমে এবং এর বিচিত্র ব্যবহার জানার মাধ্যমে আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করতে সচেষ্ট হওয়া উচিত সবার।
0 responses on "ন্যানো টেকনোলজি কি? এর সুবিধা ও গুরুত্ব জানুন"