আপনারা অনেকেই শুনেছেন যে, আপনি যদি প্রতিদিন একটি করে আপেল খান, তাহলে আপনি ডাক্তার থেকে দূরে থাকবেন । কিন্তু কেউ যদি আপনাকে বলে যে “আপনি যদি প্রতিদিন ৭ টি করে খেজুর খান, তাহলে আপনাকে কখনই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না” । এই কথাটি অবশ্য অনেকেই বিশ্বাস করবেন না, কিন্তু মুসলিম কিংবদন্তি অনুসারে এই কথাটি অনেকবার বলা হয়েছে । অনেক জায়গায় বলা হয়েছে যে, প্রতিদিন সকালে ৭ টি খেজুর, আপনাকে বিষ এবং জাদুবিদ্যা থেকে রক্ষা করে । শুধু তাই নয়, পবিত্র কোরআনে খেজুরকে জান্নাতি ফলের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে এবং এই ফলটির উল্লেখ প্রায় ২৩ বার এসেছে ।
খেজুরের ধর্মীয় গুরুত্ব থাকার পাশাপাশি, এই ফলটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী । নিয়মিত খেজুর খেলে অনেক ধরনের সমস্যা থেকে দূরে থাকা যায় । খেজুর আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য এতটাই উপকারী যে, এটিকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়ও বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয় । এই কারণেই আজকের এই আর্টিকেলে আমরা, খেজুরের উপকারিতা, ব্যবহার এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করব ।
খেজুর কি
হাজার হাজার বছর ধরে খেজুর হল মধ্যপ্রাচ্যের খাবারের একটি প্রধান উপাদান । মিষ্টি এই ফলটি মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে প্রচুর পরিমাণে চাষ করা হয় । এছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ ফ্লোরিডা এবং মেক্সিকোতেও চাষ করা হয় ।
খেজুরকে শুকনো ফল হিসেবে গণ্য করা হয়, যার অনেক ধরনের উপকারীতা রয়েছে । বিভিন্ন গুনের কারণে, খেজুরের গাছ লাইফ ট্রি, মরুভূমির রুটি ইত্যাদি নামে পরিচিত ।
খেজুরের উপকারিতা – খেজুর খেলে কি হয়
খেজুরের অনেক ধরনের পুষ্টিগুণ ও ঔষধি গুণ রয়েছে, যা এটিকে আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী করে তোলে । এখানে আমরা খেজুরের সেই উপকারিতাগুলো উল্লেখ করতে যাচ্ছি । তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন যে, খেজুর আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে অবশ্যই সাহায্য করে, তবে খেজুর কোনও রোগের নিরাময় বা ওষুধ নয় । তাহলে চলুন খেজুর খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক –
সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য – শুধু দু-একটি রোগের জন্য নয়, আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য খেজুর উপকারী । মূলত, খেজুরে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি গুণের কারনেই, এটি আমাদের সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী । খেজুরের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ফোলা সমস্যা কমাতে সাহায়তা করে । এছাড়াও, এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যে রয়েছে , যা অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং লিভারের বিষাক্ততা কমাতে সক্ষম ( তথ্যসূত্র )।
শুধু তাই নয়, খেজুরে উপস্থিত অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য, অনেক ধরনের ইনফেকশন দূর করতে সহায়তা করে, সেই সাথে এটির অ্যান্টি-ডায়াবেটিক প্রভাবও রয়েছে, যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে ( তথ্যসূত্র ) । এই সমস্ত কারণেই, খেজুরকে সার্বিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে ধরে নেয়া যায় ।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করুন – ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে খেজুর উপকারী প্রমাণিত হতে পারে । এই বিষয়ের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, খেজুরে টিউমার প্রতিরোধী এবং অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ক্যান্সারের লক্ষণগুলি কমাতে সহায়তা করে ( তথ্যসূত্র ) । এছাড়াও, নিয়মিত খেজুর খেলে, অন্ত্রে ভাল ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, যা অন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে । এছাড়াও, এটি কোলন ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সহায়তা করে ( তথ্যসূত্র ) ।
তবে একটি বিষয় মনে রাখবেন, খেজুর শুধুমাত্র ক্যান্সারের লক্ষন কমাতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে । এটি কোনভাবেই ক্যান্সারের চিকিৎসা নয় । তাই ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে ।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় – সারা বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে, হৃদরোগকে বিবেচনা করা হয় । এমন পরিস্থিতিতে খেজুর আপনাদের উপকারে আসতে পারে । কারণ খেজুর, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে ।এই বিষয়ে, NCBI ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে যে, খেজুর হৃদরোগের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে । এটিতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টি-অ্যাপোপ্টোটিক এবং হাইপোলিপিডেমিক প্রভাব রয়েছে, যা হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে সহায়ক ভুমিকা পালন করে ( তথ্যসূত্র ) ।
সেই সাথে আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, খেজুর হাই ব্লাডপ্রেশার, কোলেস্টেরল, লিপিড অক্সিডেশন (ফ্রি র্যাডিকেলের এক ধরনের প্রভাব) এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের মত সমস্যা কমাতে সক্ষম । আর এগুলোই হল কার্ডিওভাসকুলার রোগের প্রধান কারণ । খেজুরে থাকা পুষ্টি উপাদান, এই সমস্যাগুলো কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে ।
যৌন ক্ষমতা বাড়াতে – এ বিষয়ে অনেকগুলো গবেষণা করে হয়েছে এবং প্রতিবারই প্রমাণিত হয়েছে যে, খেজুর যৌন ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম । কারণ খেজুরে যে প্রোটিন পাওয়া যায়, তাতে ২৩ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড রয়েছে, যা যৌন স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী । এখানে উল্লেখ্য যে, শুধুমাত্র প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া অ্যামাইনো অ্যাসিড যৌন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে । খেজুর যৌন স্বাস্থ্য ভাল রাখার পাশাপাশি, উর্বরতা বাড়াতেও সাহায্য করে । যৌন সমস্যা নিরাময়ের জন্য তৈরী ওষুধে, খেজুরের পরাগ ব্যবহার করা হয় । প্রাচীনকাল থেকে খেজুরের পরাগ (DPP), নারী এবং পুরুষ উভয়েরই কামশক্তি এবং উর্বরতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে ।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় – গত কয়েক বছরে, মানুষ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে । দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে আমাদের শরীর বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে । এমন অবস্থায়, অনেকেই তাদের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করতে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ এবং রাসায়নিক পণ্য ব্যবহার করে । কিন্তু আপনি শুধুমাত্র খেজুর খেয়ে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশী শক্তিশালী করতে পারবেন । ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করার জন্য, প্রয়োজনীয় সমস্ত পুষ্টি উপাদান খেজুরের মধ্যে রয়েছে । খেজুরে প্রোটিন, আয়রন, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে এর পাশাপাশি, এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণও রয়েছে, যা আমাদের শরীরকে বিভিন্ন ধরনের রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে ।
মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে – বাদামের মত খেজুরও আমাদের মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য ভাল রাখতে এবং এর কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে । মানসিক টেনশনের কারণে অনেকেই মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হন । এমন পরিস্থিতিতে খেজুর খেলে, মানসিক টেনশন কমে যায় এবং সেই সাথে মস্তিষ্কের প্রদাহ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায় । আপনি যদি প্রতিদিন খেজুর খান, তাহলে আপনি নিউরোডিজেনারেটিভ রোগ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারবেন । নিউরোডিজেনারেটিভ ডিজিজ হলো মস্তিষ্কের সাথে সম্পর্কিত সেইসব রোগ, যেগুলোর কারণে মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় । খেজুর স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । একটি সমীক্ষা অনুসারে, খেজুরের মধ্যে আলঝাইমারের প্রভাব কমানোর ক্ষমতা রয়েছে । আলঝেইমার হল এমন একটি রোগ, যার ফলে মানুষের স্মৃতিশক্তি ধীরে ধীরে কমে যায় । আলঝেইমারের সমস্যা যেকোনো বয়সের মানুষের ক্ষেত্রেই হতে পারে।
সংক্রমণ উপশম – আর্টিকেলের শুরুতেই আমরা উল্লেখ করেছি যে, খেজুর অনেক গুণে সমৃদ্ধ এবং তার মধ্যে একটি হল এর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য । এই বৈশিষ্ট্যটি বিভিন্ন সংক্রমণ-সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়াকে নির্মূল করার পাশাপাশি, এগুলোর বৃদ্ধি রোধ করতে সহায়তা করে ( তথ্যসূত্র )। এর উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, খেজুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম ।
পাইলস প্রতিরোধে সহায়ক:- আপনি যদি একটানা বা দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগে থাকেন, তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে । কারণ দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগলে, তা থেকে পাইলস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে । খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, যা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে সাহায্য করে । এর ফলে আপনি পাইলস হওয়া থেকে দূরে থাকবেন ।
পেটের সমস্যা থেকে মুক্তি – পেট সংক্রান্ত সমস্যা যে কোন মানুষেরই হতে পারে । এমন অবস্থায়, শুকনো খেজুর পেটের সমস্যা নিরাময়ে ব্যবহার করা যেতে পারে । খেজুরকে একটি ক্লিনজিং এজেন্ট হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যা অন্ত্র পরিষ্কার করতে সহায়তা করে । এছাড়াও এতে ডায়রিয়া প্রতিরোধী প্রভাব রয়েছে, যা ডায়রিয়ার সমস্যা কমাতে সাহায্য করে । খেজুরের অ্যান্টিডিসেনটেরিক এবং রেচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা অ্যাসকারিস নামক অন্ত্রের কৃমিকে মেরে ফেলতে সহায়তা করে ।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বমি ও ডায়রিয়ার কারণে সৃষ্ট পানিশূন্যতার সমস্যায় খেজুর ব্যবহার করা যেতে পারে ।খেজুরের পানির নির্যাস, পাকস্থলীর হাইপার অ্যাসিডিটির পাশাপাশি রক্তের অম্লতা কমাতে সহায়তা করে । এই সমস্ত কারণে, পেটের সমস্যা কমাতে শুকনো খেজুর খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রক্তশূন্যতার সমস্যায় উপকারী – রক্তশূন্যতা সমস্যার প্রধান কারণ হল শরীরে আয়রনের ঘাটতি ( তথ্যসূত্র ) । আর এই রক্তশূন্যতার অভাব পূরণ করতে খেজুর কার্যকরী ভুমিকা পালন করে । মূলতঃ খেজুরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে । তাই নিয়মিত খেজুর খেলে, এটি আয়রনের পরিপূরক হিসাবে কাজ করে । এর ফলে কোনো ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণ হয় এবং রক্তশূন্যতার সমস্যাও কমে যায় ।
শক্তি বৃদ্ধি করতে – খেজুরকে একটি শক্তিশালী খাবার বা শক্তি বৃদ্ধিকারী খাবার হিসেবে গণ্য করা হয় । কারণ, খেজুরে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কার্বোহাইড্রেট থাকে । এটি খুব সহজেই গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয় এবং আমাদের রক্তে পৌঁছায়, যা শরীরের জন্য শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে ( তথ্যসূত্র )। এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, খেজুর শরীরকে শক্তিশালী করতে কার্যকরী ভুমিকা পালন করে ।
অন্ত্রের রোগ প্রতিরোধ করে – আপনি যদি আপনার শরীরকে সব ধরনের রোগ থেকে দূরে রাখতে চান, তাহলে আপনার পেটকে সুস্থ রাখা অত্যন্ত জরুরী । আর পেটকে সুস্থ রাখতে হলে, অন্ত্রকে সুস্থ রাখা প্রয়োজন । অন্ত্র এবং পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য ফাইবার প্রয়োজন, যা খেজুরের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে থাকে । খেজুরে উপস্থিত ফাইবার এবং পলিফেনল, অন্ত্রে খারাপ ব্যাকটেরিয়া তৈরিতে বাধা দেয় এবং অন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে ।
পেশী তৈরি করতে – আপনি যদি জিমে যান এবং আপনার পেশী দ্রুত ডেভেলপ করতে চান, তাহলে আপনি প্রোটিন পাউডার গ্রহন করার পরিবর্তে খেজুর ব্যবহার করতে পারেন । খেজুর হল একটি উচ্চ কার্বোহাইড্রেট যুক্ত ফল এবং এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে, যা পেশী বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ।
পেশী গঠনের পাশাপাশি, খেজুর কার্ডিওমায়োপ্যাথির (হৃদপিণ্ডের পেশীর রোগ) সময় হার্টের পেশীকে শক্তিশালী রাখতে সহায়তা করে ।
ত্বকের জন্য খেজুরের উপকারিতা – বর্তমানে অনেকের ক্ষেত্রেই সময়ের আগে ত্বক কুঁচকে যেতে শুরু করে, যার ফলে তাদেরকে দেখতে বয়স্ক মনে হয় । এই সমস্যা এড়াতে খেজুরের ব্যবহার উপকারী হতে পারে । প্রকৃতপক্ষে, খেজুর এবং খেজুরের বীজে অ্যান্টি-এজিং উপাদান রয়েছে, যা বার্ধক্যের ছাপ কমাতে সাহায্য করে । এছাড়াও খেজুরে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন ডি রয়েছে, যা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী । খেজুরের বীজের নির্যাসে ফাইটোহরমোন থাকে, যা ত্বকের বলিরেখা দূর করে বার্ধক্য প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে ।
হাড় মজবুত করতে – ছোট শিশুদের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য এবং তাদের হাড়গুলো শক্তিশালী করার জন্য পিতামাতারা বিভিন্ন ধরণের সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করেন । তবে আপনি শুধুমাত্র খেজুরের মাধ্যমে আপনার শিশুর হাড়কে শক্তিশালী করতে পারেন । খেজুরে সেলেনিয়াম, কপার, ম্যাগনেসিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজ থাকে । এই সমস্ত পুষ্টি উপাদান, হাড়কে মজবুত করার পাশাপাশি হাড় সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে । এছাড়াও, খেজুরে ভিটামিন কে থাকে, যা রক্ত জমাট বাঁধতে এবং হাড়ের বিপাকীয়করণে সাহায্য করে । আপনার বয়স যাই হোক না কেন, আপনার হাড় মজবুত করার জন্য আপনি খেজুর খেতে পারেন । তবে আপনার বয়স এবং অন্যান্য শারীরিক কন্ডিশান অনুযায়ী, এর পরিমাণ এবং খাওয়ার পদ্ধতি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে । অতএব, একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে আপনি খেজুর খাওয়া শুরু করুন ।
চুল সুস্থ রাখতে – আমরা সকলেই আমাদের চুলকে সুন্দর, মজবুত এবং নিরাপদ রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করি এবং সেগুলি অবলম্বন করতে অনেক ধরনের ঝামেলা পোহাতে হয় । অনেক সময় অলসতার কারণে, আমরা আমাদের চুলের সঠিক ভাবে যত্ন নিই না । কিন্তু আপনি কি জানেন যে, আপনি শুধুমাত্র খেজুর খেয়ে আপনার চুলকে সুস্থ্য রাখতে পারবেন এবং চুল সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা এড়াতে পারবেন । আসলে, খেজুরে থাকা আয়রন মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে, যা চুলের দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে । এছাড়াও, খেজুরে উপস্থিত ভিটামিন ই আপনার চুলের বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা পালন করে ।
রাতকানা দূর করতে – রাতের অন্ধত্ব বা রাত কানা রোগ হল এক ধরনের দৃষ্টি রোগ, যা nyctalopia নামেও পরিচিত । রাতকানা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা, রাতে বা কম আলোতে ঠিক মত দেখতে পান না । এই ধরনের মানুষদের পক্ষে অন্ধকার পরিবেশে দেখা প্রায় অসম্ভব । একজন সাধারণ মানুষ যেমন হালকা আলোতেও তাদের কাজ করতে পারে, কিন্তু একজন রাতকানা রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির পক্ষে তা করা খুবই কঠিন । চোখ সংক্রান্ত এই রোগের প্রধান কারণ হল ভিটামিন এ এবং আয়রনের অভাব । আর আমরা শুরুতেই বলেছি যে, খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-এ এবং আয়রন থাকে । এমন পরিস্থিতিতে, নিয়মিত খেজুর খেলে, রাতকানা রোগ থেকে অনেকটা উপশম পাওয়া যায় ।
শুকনো খেজুরের পুষ্টি উপাদান
কার্বোহাইড্রেট, শর্করা, ফাইবার এবং প্রোটিনের পাশাপাশি, খেজুরে অনেক ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে । খেজুরে থাকা পুষ্টি উপাদানের তালিকে নিচে দেওয়া হল –
পুষ্টি উপাদান | প্রতি 100 গ্রাম পরিমাণ |
পানি | 8.35 গ্রাম |
শক্তি | 371 ক্যালোরি |
প্রোটিন | 8.82 গ্রাম |
চর্বি | 6.98 গ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | 72.4 গ্রাম |
ফাইবার | 6.9 গ্রাম |
চিনি | 30.8 গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | 297 মিলিগ্রাম |
আয়রন | 10.7 মিলিগ্রাম |
ম্যাগনেসিয়াম | 92 মিলিগ্রাম |
ফসফরাস | 296 মিলিগ্রাম |
পটাসিয়াম | 374 মিলিগ্রাম |
সোডিয়াম | 516 মিলিগ্রাম |
দস্তা | 1.94 মিলিগ্রাম |
তামা | 0.364 মিলিগ্রাম |
ম্যাঙ্গানিজ | 2.22 মিলিগ্রাম |
সেলেনিয়াম | 16.4 μg |
ভিটামিন সি | 0.8 মিলিগ্রাম |
থায়ামিন | 0.892 মিলিগ্রাম |
রিবোফ্লাভিন | 1.02 মিলিগ্রাম |
নিয়াসিন | 12 মিলিগ্রাম |
pantothenic অ্যাসিড | 0.675 মিলিগ্রাম |
ভিটামিন বি-৬ | 1.2 মিলিগ্রাম |
ফোলেট ডিএফই | 381 μg |
ভিটামিন এ আইইউ | 2990 আইইউ |
ভিটামিন ই | 0.55 মিলিগ্রাম |
ভিটামিন কে | 2 µg |
ফ্যাটি অ্যাসিড মোট স্যাচুরেটেড | 1.07 গ্রাম |
ফ্যাটি অ্যাসিড মোট মনোস্যাচুরেটেড | 1.9 গ্রাম |
ফ্যাটি অ্যাসিড মোট পলিআনস্যাচুরেটেড | 3.24 গ্রাম |
খেজুর খাওয়ার উপকারিতা এবং খেজুরের পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে জানার পর, এখন আমরা খেজুর খাওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে জানব ।
খেজুর কীভাবে ব্যবহার করবেন – খেজুর খাওয়ার নিয়ম
আর্টিকেলের এই পর্যায়ে আমরা আপনাদেরকে খেজুর খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বলব । খেজুর খাওয়ার নিয়ম নিচে দেওয়া হল –
খেজুর কীভাবে খাবেন –
- প্রতিদিন সকালে ২ টি করে খেজুর নাস্তার আগে খেতে পারেন ।
- এছাড়াও খেজুরের পেস্ট বানিয়ে চিনির পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন ।
- এক গ্লাস হালকা গরম দুধের সাথে এক বা দুটি শুকনো খেজুর খেতে পারেন ।
- ঠান্ডা দুধের সাথে শুকনো খেজুর যোগ করে স্মুদি তৈরি করা যায় ।
- মিষ্টি জাতীয় যে কোন খাবারে এটি ড্রাই ফ্রুট হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন ।
কখন খাবেন:
এটা বলা হয়ে থাকে যে, শীতকালে বেশী পরিমাণে খেজুর খাওয়া উচিত । এছাড়াও, সকালের নাস্তার সাথে এটি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয় । তবে খেজুর যে কোনো সময় আপনার ইচ্ছামতো সেবন করতে পারেন ।
কতটা খাবেন:
একবারে আস্ত ২ বা ৩ টি খেজুর খাওয়া যেতে পারে। তবে ব্যক্তির স্বাস্থ্যের কন্ডিশনের উপর ভিত্তি করে, এর পরিমাণ পরিবর্তিত হতে পারে । এ ব্যাপারে একজন ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করে নিন ।
খেজুর দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার উপায় – খেজুর সংরক্ষণ করবেন যেভাবে
খেজুর দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করার জন্য নীচে দেওয়া টিপসগুলো অনুসরণ করতে পারেন –
- খেজুর কেনার সময় তাজা এবং নরম খেজুর বেছে নিন ।
- খেয়াল রাখবেন যেন খেজুরের উপর কোন ধরনের ক্রিস্টাল চিনি না থাকে ।
- সেই সাথে আরও খেয়াল রাখতে হবে, খেজুরে যেন কোনো ধরনের ছিদ্র না থাকে ।
- তাজা খেজুর ফ্রিজের মধ্যে বায়ুরোধী পাত্রে রাখুন । এভাবে আপনি এক বছর পর্যন্ত খেজুর সংরক্ষণ করতে পারবেন ।
- হিমায়িত শুকনো খেজুর বায়ুরোধী পাত্রে সংরক্ষণ করলে দীর্ঘ দিন ব্যবহার করা যায় ।
সবাই কি খেজুর খেতে পারে ?
না । সব মানুষের খেজুর খাওয়া উচিত না । নিচে উল্লেখিত ব্যক্তিদের খেজুর খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এই ধরনের মানুষ খেজুর খেলে, তাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশী ।
- ডায়রিয়ায় আক্রান্ত থাকা অবস্থায় খেজুর খাওয়া উচিত নয় ।
- যাদের খেজুরের কারণে অ্যালার্জি হয়, তাদের এটি খাওয়া উচিত নয় ।
- কিডনি রোগীদের খেজুর থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকা উচিত ।
- খেজুর স্থূলতা বাড়াতে পারে, তাই যারা অতিরিক্ত মোটা, তাদের খেজুর খাওয়া উচিত নয় ।
- গর্ভবতী মহিলাদের খেজুর খাওয়া উচিত নয়, কারণ এটি খেলে শরীরের তাপ বাড়তে পারে ।
- যারা মাংসপেশির দুর্বলতায় ভুগছেন তাদের খেজুর খাওয়া একদম উচিত নয় । কারণ পেশির দুর্বলতার অর্থ হল, আপনার শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে গেছে । এমন অবস্থায় খেজুর খেলে শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে ।
খেজুরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া – খেজুর খাওয়ার অপকারিতা
খেজুর খাওয়ার অপকারিতা নিচে দেওয়া হল –
- খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে । তাই অতিরিক্ত পরিমাণে খেজুর খেলে, পেট ফাঁপা, গ্যাস এবং পেটে ব্যথা হওয়ার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে ( তথ্যসূত্র )।
- ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের এটির অত্যধিক সেবন এড়ানো উচিত, কারণ অতিরিক্ত খেজুর খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে যেতে পারে ।
শেষ কথা
আপনারা নিশ্চয়ই, খেজুর খাওয়ার সুবিধা এবং অসুবিধা দুটোই খুব ভালো করে জেনে গেছেন । আমাদের প্রতিদিনের জীবনে, শক্তি বাড়ানো থেকে শুরু করে অনেক রোগের ঝুঁকি কমাতে খেজুর খাওয়ার উপকারিতা রয়েছে । সেই সাথে এটাও মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, খেজুর কোনো ধরনের ওষুধ নয়, তাই এটিকে চিকিৎসা হিসেবে মনে করা যাবে না । আর একটি বিষয় মনে রাখবেন, খেজুর সীমিত পরিমাণে সেবন করুন । অতিরিক্ত পরিমাণে খেজুর খেলে আপনার লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশী হতে পারে । আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান । ধন্যবাদ
0 responses on "খেজুরের উপকারিতা, ব্যবহার এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া"