• No products in the cart.

কৈলাস পর্বত, কোন বিজ্ঞানী যার রহস্যকে উদঘাটন করতে পারেনি

তিব্বতের ঠিক পশ্চিম প্রান্তে, গ্যাংডিস পর্বতশ্রেণীর বুকে, অতিকায় পিরামিডের মত দাঁড়িয়ে আছে মাউন্ট কৈলাস (২২০২৮ ফুট) বা কৈলাস পর্বত বা গাং রিনপোচে (Mount Kailash) । গ্রানাইট ও চুনাপাথরের তৈরি এই পর্বতের পাদদেশে শুয়ে আছে রাক্ষসতাল হ্রদ এবং মানস সরোবর । হিন্দু, বৌদ্ধ, বন এবং জৈন ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই কৈলাস পর্বত (Mount Kailash)।

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, কৈলাস পর্বতের চুড়া হল, দেবাদিদেব মহাদেবের নিভৃত আবাস । এখানে বসেই তিনি সৃষ্টি, ধ্বংস, সংহার ও প্রলয় নিয়ন্ত্রণ করেন । বৌদ্ধ ধর্মের মানুষের কাছে কৈলাস পর্বত হল সৃষ্টির প্রাণকেন্দ্র । বজ্রায়ণ শাখার বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন, কৈলাস পর্বতের চুড়ায় ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন ধ্যানের দেবতা, হেরুকা চক্রসাম্ভারা । তিব্বতের বন ধর্মের অনুসারীরা বিশ্বাস করেন, কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গে তাঁদের আকাশ দেবতা সিপাইমেনের আবাস । জৈন ধর্মের অনুসারীদের কাছেও অত্যন্ত পবিত্র এই কৈলাস পর্বত । কারণ প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেব, এই কৈলাস পর্বতেই নির্বাণ লাভ করেছিলেন ।

রহস্যের খনি কৈলাস

কৈলাসের মত রহস্যময় পর্বত সারা বিশ্বে আর একটিও নেই । কারণ, এই কৈলাস পর্বতকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে আবর্তিত হয়ে চলেছে রহস্যের কুয়াশা । স্থানীয় মানুষ ও তীর্থযাত্রীরা, এমন কিছু বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ করেন, যেগুলির ব্যাখ্যা সাধারণভাবে দেওয়া সম্ভম নয় । তাদের মধ্যে অনেকেই বলেন যে, দিনের বিভিন্ন সময় নাকি রঙ পরিবর্তন করে কৈলাস পর্বত । সেই সাথে বদলে যায় কৈলাস পর্বতের ভূ-প্রকৃতি । কৈলাস পর্বতের আঙিনায় পৌঁছে যাওয়া মানুষের শরীরে দ্রুত বার্ধক্যের ছাপ ফুটে ওঠে । অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে নখ ও চুল ।

রহস্য আরও বেশী গভীর করে তোলে কৈলাস পর্বতের গায়ে বরফ ও পাথরের মেলবন্ধনে তৈরি হওয়া পবিত্র ‘স্বস্তিকা’ এবং ‘ওঁ’ চিহ্ন । গুগল আর্থের তোলা একটি ছবিকে নিয়ে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো বিশ্ব । যে ছবিতে দেখা যায় কৈলাশ পর্বতের একটি বিশেষ জায়গায়, আলো ও ছায়ার মিশ্রনে সৃষ্টি হয়েছে হাস্যরত শিবের মুখাবয়ব ।

১৯৯৯ সালে, রাশিয়ার চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডঃ আর্নেস্ট মুল্ডাশেভ, এক বিশাল দল নিয়ে গিয়েছিলেন কৈলাসে । দলটিতে ছিলেন পদার্থবিদ, ইতিহাসবিদ এবং ভূতত্ববিদেরা । এই দলটি কৈলাস পর্বতের আশেপাশে কয়েক মাস কাটিয়েছিলেন । কথা বলেছিলেন অসংখ্য তীর্থযাত্রী, হিন্দু ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সাথে । কৈলাসে থাকাকালীন সময়ে, এই দলটি কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল । দেশে ফিরে যাওয়ার পর ডঃ মুল্ডাশেভ জানিয়েছিলেন, রাতের অন্ধকারে পাল্টে যায় কৈলাস পর্বত । হাড় হিম করা অদ্ভুত আওয়াজ, কৈলাস পর্বতের দিক থেকে ভেসে আসতে থাকে ।

এক রাতে তাঁরা, বিশাল এক পাথর খসে পড়ার মত অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন । দলের প্রত্যেক সদস্য নিশ্চিত ছিলেন যে, ওই আওয়াজটি কৈলাসের ঢাল বেয়ে নেমে আসা কোনও পাথরের আওয়াজ নয় । কারণ শব্দটা আসছিল কৈলাস পর্বতের ঠিক ভেতর থেকে । তাঁদের সবারই মনে হয়েছিল, কৈলাস পর্বতের ভেতরটি হয়ত ফাঁপা ।

কয়েক মাস অনুসন্ধান চালানোর পর, ডঃ মুল্ডাশেভ এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন । তিনি বলেছিলেন, কৈলাস পর্বত কোনও প্রাকৃতিক পর্বত নয় । কৈলাস হল মানুষের তৈরি করা প্রথম পিরামিড । তিনি ধারণা করেছিলেন, কৈলাস পর্বতের ভেতরে থাকতে পারে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মহাপুরুষদের কোন গোপন নগররাষ্ট্র ‘জ্ঞানগঞ্জ’ বা ‘শাম্ভালা’। যদিও ডঃ মুল্ডাশেভের এই সিদ্ধান্তগুলিকে, বিশ্বের বেশিরভাগ বিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ ও ভূতত্ববিদেরা এক বাক্যে খারিজ করে দিয়েছিলেন ।

কৈলাস পর্বতের চুড়ায় আরোহণকে ঘিরেও রহস্যের মায়াজাল আবর্তিত হয়ে চলেছে । পৃথিবীর প্রায় সমস্ত পরিচিত ও বিখ্যাত পর্বতশৃঙ্গে মানুষের পদচিহ্ন পরলেও, আজ অবধি কৈলাস শৃঙ্গে পা রাখতে পারেনি কোনও মানুষ । অথচ পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গগুলির তুলনায় কৈলাস পর্বত শৃঙ্গের উচ্চতা অনেক কম । বেশ কয়েকবার কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গে আরোহণের চেষ্টা করাও হয়েছিল । কিন্তু আসেনি কোন সাফল্য । যদিও বজ্রায়ণ শাখার বৌদ্ধদের লোকগাথায়, একজন মানুষের কাহিনি বলা হয়, যিনি কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গে পা রেখেছিলেন । তবে এটাও বলা হয় যে, সেই ব্যক্তি কোনও সাধারণ মানুষ ছিলেন না এবং এ ব্যাপারে ইতিহাসের কাছে কোন ধরনের প্রমাণ বা তথ্য নেই ।

কৈলাস পর্বতের রহস্য

পৃথিবীর কেন্দ্র: উত্তর মেরু পৃথিবীর একদিকে এবং দক্ষিণ মেরু পৃথিবীর অন্য দিকে । আর হিমালয়, এই দুটির মাঝখানে অবস্থিত । আর হিমালয়ের কেন্দ্রবিন্দু হল এই কৈলাস পর্বত । বিজ্ঞানীদের মত অনুসারে এটাই পৃথিবীর কেন্দ্র ।

অতিপ্রাকৃত শক্তি কেন্দ্র: এটি এমন একটি কেন্দ্র যাকে অক্ষ মুন্ডি বলা হয় । অক্ষ মুন্ডি অর্থ হল পৃথিবীর নাভি বা স্বর্গীয় মেরু এবং ভৌগলিক মেরু কেন্দ্র । এটি স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যে সংযোগ করার একটি বিন্দু, যেখানে দশটি দিক মিলিত হয় । রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের মতে, অ্যাক্সিস মুন্ডি বা অক্ষ মুন্ডি হল সেই জায়গা, যেখানে অতিপ্রাকৃত শক্তি প্রবাহিত হয় এবং মানুষ সেই শক্তিগুলির সাথে যোগাযোগ করতে পারে ।

পর্বতটি পিরামিডের মতো: কৈলাস পর্বত একটি বিশাল পিরামিডের মত, যা ১০০ টি ছোট পিরামিডের কেন্দ্র । কৈলাস পর্বতের গঠন একটি কম্পাসের ৪ টি বিন্দুর মতো এবং এই পর্বত একটি নির্জন স্থানে অবস্থিত । সেখানে আর কোনো বড় পর্বত নেই ।

দুটি রহস্যময় হ্রদের রহস্য: এখানে ২ টি প্রধান হ্রদ রয়েছে – প্রথমটির নাম হল, মানসরোবর । যা বিশ্বের বিশুদ্ধ পানির সর্বোচ্চ হ্রদগুলির মধ্যে একটি এবং এই হ্রদের আকার অনেকটা সূর্যের মতো । এই মানসরোবর হ্রদে একবার স্নান করলে রুদ্রলোক লাভ হয় বলে বিশ্বাস করা হয় । আর দ্বিতীয় হ্রদটির নাম হল, রাক্ষস হ্রদ । যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ নোনা পানির হ্রদগুলির একটি এবং যার আকৃতি অনেকটা চাঁদের মতো । কথিত আছে যে, এই হ্রদের কাছেই রাবণ, শিবের থেকে বর লাভের জন্য কঠিন তপস্যা করেছিলেন । তাই এই হ্রদকে রাবণতালও বলা হয় । এই রাক্ষস হ্রদটির আয়তন 225 বর্গকিলোমিটার । এই দুই হ্রদ সূর্য এবং চন্দ্র শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে, যা ইতিবাচক এবং নেতিবাচক শক্তির সাথে সম্পর্কিত । দক্ষিণ দিক থেকে তাকালে একটি স্বস্তিক প্রতীক দেখা যায় । এই হ্রদ দুটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হয়েছিল, নাকি এই হ্রদগুলো তৈরি করা হয়েছিল, তা এখনও একটি রহস্য হয়ে রয়েছে?

পুণ্যবান আত্মারা বাস করতে পারে: অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, শুধুমাত্র পুণ্যবান আত্মাই এখানে থাকতে পারে । কৈলাস পর্বত এবং এর চারপাশের পরিবেশ স্টাডি করা রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা যখন তিব্বতের মন্দিরে ধর্মীয় গুরুদের সাথে দেখা করেছিলেন, তখন তারা বলেছিলেন যে, কৈলাস পর্বতের আশেপাশে একটি অতিপ্রাকৃত শক্তি প্রবাহিত রয়েছে । যেখানে তিব্বতের সন্ন্যাসীরা এখনও আধ্যাত্মিক গুরুদের সাথে টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ করে ।

ডমরু এবং ওম শব্দ: আপনি যদি কৈলাস পর্বত বা মানসরোবর হ্রদের আশাপাশের এলাকায় যান, তাহলে আপনি একটি অবিরাম শব্দ শুনতে পাবেন । যা প্রথম অবস্থায় শুনলে মনে হবে, একটি বিমান কাছাকাছি কোথাও উড়ছে । কিন্তু একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে এই ধ্বনিটি ‘ডমরু’ বা ‘ওম’ ধ্বনির মতো শোনায় । অনেক বিজ্ঞানী বলছেন, এই শব্দটি বরফ গলার কারণে হতে পারে । আবার এমনও হতে পারে যে, আলো ও শব্দের মধ্যে এমন মিথস্ক্রিয়া আছে যেখান থেকে ‘ওম’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে । আবার অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করেন, পাহাড়ে বরফের সাথে বাতাসের সংঘর্ষে এই ‘ওম’ শব্দ উৎপন্ন হয় ।

আকাশে আলোর ঝলকানি: কৈলাস পর্বতের আকাশে অনেকবার ৭ ধরনের আলো জ্বলতে দেখা গেছে বলে দাবি করা হয় ।নাসার বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, এখানে উপস্থিত চৌম্বক শক্তির কারণে এমনটা হতে পারে । এখানকার চৌম্বকীয় শক্তি আকাশের সাথে মিলিত হয়ে এই ধরনের আলো তৈরি করতে পারে ।

ইয়েতি মানবের রহস্য: হিমালয়ের মানুষেরা বলে যে, ইয়েতি মানব হিমালয়ে বাস করে । কেউ একে বাদামী ভাল্লুক বলে, কেউ বলে বুনো মানুষ, আবার কেউ কেউ একে তুষারমানুষ বলে । একটি জনপ্রিয় বিশ্বাস আছে যে, এই তুষার মানব বা ইয়েতি, মানুষকে হত্যা করে এবং খায় । অনেক বিজ্ঞানী একে নিয়ান্ডারথাল মানুষ বলে মনে করেন । বিশ্বজুড়ে প্রায় ৩০ টিরও বেশি বিজ্ঞানী দাবি করেছেন যে, হিমালয়ের তুষারময় অঞ্চলে তুষার মানবের অস্তিত্ব রয়েছে ।

ধর্মীয় বিশ্বাস

হিন্দু ধর্মের মানুষের বিশ্বাস অনুসারে, ভগবান শিব, তার পরিবারের সাথে কৈলাস পর্বতে বসবাস করেন । তাদের পাশাপাশি, অনেক দেব-দেবী এবং ঋষিদের আবাসস্থলও হল এই কৈলাস পর্বত । হিন্দুরা আরও বিশ্বাস করেন যে, এই পর্বতে কোনো সাধারণ মানুষ যেতে পারবে না । কৈলাস পর্বতের চুড়ায় আরোহণ করার জন্য বিশেষ কৃতিত্বের প্রয়োজন । যে ব্যক্তি কখনো কোন পাপ করেনি, শুধুমাত্র সেই ব্যক্তি এই পর্বতের চুড়ায় আরোহণ করতে পারবে । আর এই কারনেই অনেক পর্বতারোহী কৈলাস পর্বতের চুড়ায় আরোহণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন ।

পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী, কৈলাস পর্বতে অতিপ্রাকৃত শক্তির অবস্থান । পুণ্যবান আত্মারা এই পর্বতে বাস করেন । একে স্বর্গের দরজাও বলা হয়ে থাকে । বিশ্বাস করা হয় যে, অনেক তপস্বী আজও এখানে তপস্যা করছেন । আর এই তপস্বীদের তপস্যায় যেন কোন ধরনের বিঘ্ন না ঘটে, সেই কারণে কোন মানুষ এই পর্বতের উপরে উঠার চেষ্টা করলে বিভিন্ন ধরনের বাধা আসতে শুরু হয় ।

হিন্দু ধর্ম ছাড়াও, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অনুসারীরাও এই কৈলাস পর্বতকে পবিত্র বলে মনে করেন । জৈন ধর্মে এই পর্বতের অঞ্চলকে অষ্টপদ বলা হয় । এখান থেকেই তাদের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভদেব মোক্ষ লাভ করেন । একই সাথে, বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরাও এই পর্বতকে গৌতম বুদ্ধের আবাস বলে মনে করে । বুদ্ধের ডেমচোক রূপ কৈলাস পর্বত থেকেই নির্বাণ লাভ করেছিল । কৈলাস পর্বতের ধর্মীয় বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে চীন সরকার সেই পর্বতের চুড়ায় আরোহণ নিষিদ্ধ করেছে ।

জেতসুন মিলারেপা

একাদশ শতাব্দীতে, পশ্চিম তিব্বতের (Tibet) এক সম্ভ্রান্ত ধনী পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন জেতসুন মিলারেপা (১০৫২-১১৩৫ খ্রিস্টাব্দ) । বাবার মৃত্যুর পর তার সমস্ত সম্পত্তি কেড়ে নিয়েছিলেন তার কাকা ও কাকিমা । মিলারেপা, তার কাকা কাকিমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য, চলে গিয়েছিলেন তন্ত্র মন্ত্র ও কালা জাদু শিখতে । আর এই কালা জাদু শিক্ষা পরখ করার জন্য তিনি বহু মানুষকে হত্যা করেছিলেন । কিন্তু একসময় মিলারেপার মধ্যে তীব্র অনুশোচনার জন্ম হয় । পরবর্তীতে তিনি, বৌদ্ধ ধর্মের কাইগু শাখার সিদ্ধা, মারপা লোতসাওয়ার কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহন করেন । প্রভু বুদ্ধের আলোয় আলোকিত মিলারেপা, তিব্বতের ইতিহাসের অন্যতম সিদ্ধপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন ।

তিব্বত তখন পরিচালিত হত ‘বন’ ধর্মের সিদ্ধপুরুষ নারো বনচুঙের কথায় । এমন সময়, পবিত্র মানস সরোবরের অধিকার নিয়ে, বৌদ্ধ ও বন ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়েছিল । একই সাথে, মিলারেপা এবং বনচুঙের মধ্যে শুরু হয়েছিল কালা জাদুর লড়াই । এই লড়াইয়ে যিনি জিতবেন তিনিই পাবেন পবিত্র মানস সরোবরের অধিকার । কিন্তু অনেক চেস্টার পরেও কেউ কাউকে হারাতে পারেননি । তখন ঠিক হয়েছিল, যিনি আগে কৈলাস পর্বতের চুড়ায় পা রাখবেন, তাঁর দখলেই থাকবে মানস সরোবর ।

প্রতিযোগিতা লড়ার জন্য মিলারেপা ও বনচুঙ পৌঁছে গিয়েছিলেন কৈলাস পর্বতের পাদদেশে । বনচুঙ বসে পড়েছিলেন তার নিজের সুদৃশ্য জয়ঢাকের ওপর । আর সেই জয়ঢাক উড়ে যাচ্ছিল কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গের দিকে । কিন্তু তখনও ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসেছিলেন মিলারেপা । এভাবে একসময় বনচুঙ প্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গের কাছাকাছি । ঠিক তখনই ধ্যানমগ্ন অবস্থা থেকে চোখ খুলেছিলেন মিলারেপা । কৈলাস পর্বতের চূড়া ঘিরে রাখা কালো মেঘের মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছিল । সূর্যের এক অস্বাভাবিক উজ্জ্বল আলোর রশ্মি এসে পড়েছিল মিলারেপার শরীরে । সেই অদ্ভুত সূর্যরশ্মিটি ধরে, বনচুঙের অনেক আগেই মিলারেপা, কৈলাস পর্বতের চুড়ায় পৌঁছে গিয়েছিলেন । এবং সেই সাথে নিয়েছিলেন মানস সরোবরের দখল । তবে কৈলাস পর্বতের চুড়া থেকে নেমে এসে মিলারেপা বলেছিলেন, কেউ যেন কোনওদিন এই পর্বতের চুড়ায় আরোহণের চেষ্টা না করে । কারণ কৈলাস পর্বতের চুড়ায় বিশ্রাম নিচ্ছেন স্বয়ং ভগবান ।

আরোহণের চেষ্টা করেছিলেন রাটলেজ ও উইলসন

হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও বন ধর্মে কৈলাস পর্বতে পা রাখা নিষিদ্ধ । কারণ কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গে পা রাখার অর্থ হল, কোটি কোটি মানুষের বিশ্বাসকে পদদলিত করা । তবুও কিছু কিছু মানুষের আকাশচুম্বী অহঙ্কারকে আটকানো সম্ভব হয়নি । তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, কয়েকজন ইউরোপীয় পর্বতারোহী আলাদা আলাদা ভাবে কৈলাস শৃঙ্গ আরোহণের চেষ্টা করেছিলেন । পর্বতের চুড়ার দিকে এগিয়ে যেতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের, কিন্তু তাদের কেউ আর ফিরে আসেননি । তাই জানা সম্ভম হয় নি, তাঁরা কারা ছিলেন এবং তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল ।

আলমোড়ার ব্রিটিশ ডেপুটি কমিশনার ও পর্বতারোহী হাগ রাটলেজ, কৈলাশ পর্বতে প্রথম প্রথাগত অভিযান পরিচালানোর কথা চিন্তা করেন । তিনি, ১৯২১ সালে আল্পসে, পর্বতারোহণের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন । বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে, তিনি ৩ বার নন্দাদেবী পর্বত শৃঙ্গে আরোহণের চেষ্টা চালিয়েছিলেন । ১৯৩৩ ও ১৯৩৬ সালে এভারেস্ট অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ।

একটি সরকারি কাজের জন্য, ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে, রাটলেজ তিব্বতে গিয়েছিলেন । গার্তোকের প্রশাসক (গারপোন) অন্য একটি কাজে ব্যস্ত থাকায় কৈলাস পর্বত পরিক্রমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাটলেজ । স্ত্রী ডরোথি ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্নেল আর.সি উইলসনকে সাথে নিয়ে কৈলাস পর্বত পরিক্রমা করেছিলেন । একেবারে কাছ থেকে কৈলাস পর্বতকে দেখার পর, রাটলেজ ও উইলসন এই পর্বতের শিখরে ওঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন । অভিযান করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন অভিজ্ঞ শেরপা সাতানকে । কৈলাসের চুড়ায় আরোহনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন কৈলাস পর্বতের উত্তরের ঢালকে । পথ যদিও ভয়ঙ্কর, তবুও জোরকদমে চলছিল পর্বত আরোহনের প্রস্তুতি পর্ব । কিন্তু হঠাৎই রাটলেজকে আলমোড়াতে ডেকে পাঠানো হয়েছিল । স্ত্রীকে নিয়ে ফেরার পথ ধরেছিলেন রাটলেজ ।

কর্নেল উইলসন ও শেরপা সাতান, কৈলাসে থেকে গিয়েছিলেন । খুঁজে নিয়েছিলেন কৈলাস পর্বতের চুড়ায় ওঠার নতুন পথ । প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে, এক রোদ ঝলমলে সকালে, কৈলাস পর্বতের উওর-পূর্ব গিরিশিরা দিয়ে, কৈলাসের চুডার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা । পৌঁছেও গিয়েছিলেন গিরিশিরাটির প্রায় মাঝামাঝি অংশে । কিন্তু গিরিশিরার ওপর থাকা একটি বড় বোল্ডারের কাছে পৌঁছনোর পরেই আবহাওয়া বদলে যায় ।

ঘন অন্ধকার ঘিরে ধরেছিল কর্নেল উইলসন ও শেরপা সাতানকে । উন্মত্ত বাতাস, বাজপাখির মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুই পর্বত আরোহীর ওপর । বাতাসের ঝাপটায় কয়েক হাজার ফুট নিচে ছিটকে পড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল এই দুই পর্বত আরোহীর । অনেক কষ্টে, কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে নিচে নেমে এসেছিলেন দুই আরোহী । এর পরেও তাঁরা বেশ কয়েকবার এই পর্বতের চুড়ায় ওঠার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু সেই বিশেষ বোল্ডারটির কাছে পৌছা মাত্রই বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন তাঁরা । কখনও ঘন কালো মেঘ, কখনও প্রবল তুষারপাত, কখনও ঝোড়ো বাতাসের কারনে ফিরে আসতে হয়েছিল তাঁদের । রহস্যময় সেই স্থানটি পার হওয়ার সব ধরনের চেষ্টা বিফলে গিয়েছিল । অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে পুনরায় ভারতে ফিরে এসেছিলেন উইলসন ।

ফিরে গিয়েছিলেন টিচি

রাটলেজ ও উইলসনের কৈলাস পর্বত অভিযানের প্রায় ১০ বছর পর, ১৯৩৬ সালে, অস্ট্রিয়ার পর্বতারোহী হারবার্ট টিচি, কৈলাস পর্বত আরোহণের চেষ্টা করেছিলেন । তবে তিনি কৈলাস পর্বত আরোহণ করার উদ্দেশ্য নিয়ে তিব্বতে যাননি । টিচি গিয়েছিলেন নীলকঙ্কর হিমলের গুরলা মান্ধাতা (২৫২৪৩ ফুট) পর্বত শৃঙ্গ আরোহণ করার উদ্দেশ্যে । তার আগে তিনি কম উচ্চতার কৈলাস পর্বত আরোহণ করে গা ঘামিয়ে নেবেন ভেবেছিলেন ।

কৈলাস পর্বত অভিযানে সঙ্গী হওয়ার জন্য টিচি আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গার্তোকের তরুণ শাসককেও । কৈলাস পর্বত শৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে গারপোন বলেছিলেন,” একমাত্র পাপমুক্ত কোন মানুষই পা রাখতে পারবেন কৈলাস পর্বতের শৃঙ্গে । তাই আমি নিজেও যাব না, আর আপনাকেও যেতে নিষেধ করব। কারণ এই পর্বতের চুড়ায় আরোহন করার চেস্টার ফলাফলটা বীভৎস হতে পারে । এই কথা শোনার পর ” অজানা এক আতঙ্কে শিউরে উঠেছিলেন টিচি । বাতিল করেছিলেন কৈলাশ অভিযান করার সিদ্ধান্ত ।

মেসনারকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল চিন

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে পর্বতারোহণ জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন ইতালির পর্বতারোহী রেইনহোল্ট মেসনার । পৃথিবীর ১৪ টি উচ্চতম পর্বত শৃঙ্গের মধ্যে বারোটিই তিনি আরোহণ করে ফেলেছিলেন । বাকি ছিল শুধু মাকালু ও লোৎসে পর্বত । যা তিনি পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৮৬ সালে আরোহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । এই পর্বতারোহীকে, কৈলাস পর্বতে আরোহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল চিন । তিব্বতের মানুষদের ধর্মীয় ভাবনায় আঘাত করার উদ্দেশ্যেই হয়ত এই কাজটি করেছিল চিন । কারণ সেই সময় প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছিল চিন ও তিব্বতের সম্পর্ক ।

মেসনার এর আগেই ২ বার কৈলাস পর্বত পরিক্রমা করেছিলেন । বুঝেছিলেন ৪ টি ধর্মের মানুষদের কাছে কৈলাস পর্বত হল ঈশ্বরের প্রতিরূপ । তাই চিনের আমন্ত্রণকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই দার্শনিক পর্বতারোহী মেসনার । চিনের দূতকে বলেছিলেন, বিশ্বে কৈলাস পর্বতের থেকেও কঠিন পর্বত শৃঙ্গ অনেক রয়েছে । তিনি সেই সব পর্বত শৃঙ্গে আরোহণ করতে চান ।

হাল ছাড়েনি চিন

১৯৯১ সালে, জাপান এবং চিনের ১৭ জন বিজ্ঞানীকে, এক বৈজ্ঞানিক অভিযানের কথা বলে কৈলাস পর্বতে আরোহণ করতে পাঠিয়েছিল চিন । পুরো দলটি অবিশ্বাস্যভাবে হারিয়ে গিয়েছিল এক ভয়ঙ্কর তুষারধসের অতর্কিত আঘাতে । এই মর্মান্তিক ঘটনার পরেও শিক্ষা হয়নি চিনের । ২০০১ সালে, স্পেনের একটি দলকে কৈলাস পর্বত আরোহণ করার অনুমতি দিয়েছিল চিন । চিনের এই সিদ্ধান্তে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন কিংবদন্তি মেসনার । স্পেনের দলটিকে উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেছিলেন, “তোমরা হয়ত এই পর্বতের চুড়ায় পা রাখতে পারবে । কিন্তু মানুষের মনকে কখনই জয় করতে পারবে না । তাই যদি বাহাদুরি দেখাতে চাও তাহলে আরও কঠিন পর্বত আরোহণ করে দেখাও । কারণ কৈলাস পর্বত উঁচুও নয় এবং কঠিনও নয় ।”

মেসনারের সেই বক্তব্য দাবানলের মত ছড়িয়ে গিয়েছিল বিশ্বের কোণে কোণে । উঠেছিল প্রতিবাদের ঝড় । যার কারণে অভিযান বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল স্পেনের সেই দলটি । প্রবল জনরোষ ও আন্তর্জাতিক চাপের সামনে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল চিন সরকার । আইন করে পর্বতারোহীদের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল কৈলাস পর্বতের দরজা । কৈলাস পর্বত হয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর একমাত্র পর্বত, যার চুড়ায় আর কোনওদিনও পা রাখা যাবে না ।

তবুও মনে প্রশ্ন জাগে

কৈলাস পর্বতের চুড়ায় আরোহণের উদ্দেশ্যে যে অভিযানগুলি পরিচালিত হয়েছিল, সেগুলি সফল হয়নি কেন? পরিক্রমা পথের মালবাহক ও গাইডেরা শোনান বিভিন্ন ধরনের কাহিনি । যে কাহিনিগুলির সত্যতা সম্পর্কে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি । তাঁরা ৪ জন ইউরোপীয় বিজ্ঞানীর কথা বলেন । অনেকবার বারণ করা সত্ত্বেও তাঁরা কৈলাস পর্বতের শিখরে পৌঁছতে চেয়েছিলেন । গিরিপথ ধরে অল্প কিছুটা উঠেই নেমে এসেছিলেন তারা । তারা কেন ফিরে এসেছেন তার কারণ না জানিয়ে, ফিরে গিয়েছিলেন দেশে । ৪ জন বিজ্ঞানীর মধ্যে, ২ জন বিজ্ঞানী প্রাণ হারিয়েছিলেন অজানা কোনও কারণে ।

শোনা যায় সাইবেরিয়ার আরও একদল পর্বতারোহীর কথা । তাঁরাও উত্তর-পূর্ব গিরিশিরা ধরে কৈলাসের চুড়ায় উঠতে শুরু করেছিলেন । একটি বিশেষ জায়গা পার হওয়ার পর থেকেই, হঠাৎ তাঁদের বয়স বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল । মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সাদা হয়ে গিয়েছিল তাদের চুল ও দাড়ি । নরম হয়ে গিয়েছিল শরীরের সমস্ত পেশি । ভয় পেয়ে তাঁরাও দ্রুত ফিরে এসেছিলেন । দেশে ফেরার পর মারা গিয়েছিলেন এক পর্বতারোহী । ৮০ বছর বয়সের বৃদ্ধের মত নাকি দেখতে হয়ে গিয়েছিল ২৮ বছরের সেই যুবকের চেহারা ।

গাইড ও মালবাহকেরা বলেন, কৈলাস পর্বতের গায়ে পা রাখা মাত্র, শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড । এক নিমেষেই পরিবর্তন হয়ে যায় সামনের পথ । হঠাৎ সামনে দেখা দেয় তুষার ফাটল, খাড়া দেয়াল বা মিশকালো গিরিখাত । আগে থেকে এই জিনিসগুলি চোখে ধরা পড়ে না । তাই সঠিক পথে এগিয়ে গিয়েও বার বার ভূল পথ ধরতে দেখা গিয়েছে পর্বতারোহীদের । আর সেই পথ তাঁদেরকে নিয়ে গিয়েছে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ।

বিজ্ঞানীরা বলেন, এই সমস্ত কাহিনিগুলো কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও ধর্মভীরু তিব্বতের মানুষের কল্পনার ফসল । অনেকেই বলেন যে, এই কাহিনিগুলি মূলত কৈলাশকে পবিত্র রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা মাত্র । তবে একটি প্রশ্নের উত্তর বা ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে পারেন না । আর তা হল, ২০০১ সালের আগে পৃথিবীর সমস্ত উচ্চতম পর্বতগুলোতে পা রেখেছে মানুষ । কিন্তু বারং বার চেষ্টা করার পরেও, কেন কোনও মানুষের পক্ষে কৈলাস পর্বতের চুড়ায় আরোহণ করা সম্ভব হয়নি? মেলেনি কোন উত্তর, তাই কৈলাস পর্বত আজও সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে এক রহস্যময় কুহেলিকা হয়ে রয়েছে । যে কুহেলিকা শত শত বছর ধরে আকর্ষণ করে চলেছে সমগ্র মানবজাতিকে । কিন্তু, কৈলাস এখনও নিজেকে উন্মোচিত করেনি মানুষের কাছে ।

আর্টিকেলটি নিয়ে যে কোন ধরনের প্রশ্ন বা মন্তব্য থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানান ।

 

0 responses on "কৈলাস পর্বত, কোন বিজ্ঞানী যার রহস্যকে উদঘাটন করতে পারেনি"

Leave a Reply

© Technial Bangla. All rights reserved. 2025