ডিজিটাল এই যুগে কম্পিউটার সম্পর্কে শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে কম্পিউটার পাওয়া যায় এখন ঘরে ঘরে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে কম্পিউটার এমনভাবে মিশে গেছে যে অনেক সময় আমরা কম্পিউটারের ব্যাপারে আলাদা করে চিন্তা করি না। আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়তই এখন কম্পিউটার থাকে। তবে আমরা সময়ের সাথে সাথে শুধু ডেস্কটপ ও ল্যাপটপকেই এখন কম্পিউটার বলে মনে করি। কিন্তু ব্যাপারটি মোটেও তেমন নয়। আধুনিক যুগে এসে আমরা সবখানে কম্পিউটার দেখতে পাই। এমনকি আমাদের হাতের স্মার্টফোনটিও আসলে ছোটখাটো একটি কম্পিউটার।
আজকের এই পোস্ট থেকে আমরা জেনে নেবো কম্পিউটার আসলে কী। কাকে আমরা কম্পিউটার বলবো এবং কাকে বলবো না এই বিষয়ে অস্পষ্টতা দূর হবে এই পোস্ট থেকে। সেই সঙ্গে কম্পিউটারের কিছুটা ইতিহাস এবং কম্পিউটারে কী কী থাকে সে বিষয়েও কিছুটা আলোচনা থাকবে এখানে।
কম্পিউটার কী?
কম্পিউটারের আভিধানিক অর্থ দাড়ায় গণনার যন্ত্র। তবে কী কম্পিউটার শুধু গণনাই করে? হ্যাঁ, প্রথম দিকে তৈরি কম্পিউটারগুলো শুধু বিভিন্ন গণনার কাজেই ব্যবহৃত হতো। তবে দিনে দিনে কম্পিউটারের উন্নতি হয়েছে। কম্পিউটার শুধু নম্বর গণনা থেকে যে কোনো ধরণের হিসাব ও গণনা করতে সক্ষম হয়েছে। আধুনিক কম্পিউটার এত শক্তিশালী যে বড় বড় অনেক জটিল গণনা সে কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে করে ফেলতে সক্ষম।
অর্থাৎ আধুনিক কম্পিউটার আভিধানিক অর্থ থেকে অনেকটাই আলাদা হয়ে গিয়েছে। সোজা কথায় কম্পিউটার এমন একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র যাকে ইচ্ছামতো প্রোগ্রাম করা যায়। কম্পিউটারে আগে থেকেই বিভিন্ন নির্দেশনা ইনপুট করা যায়। এই ইনপুট দেয়ার মাধ্যমেই কম্পিউটারে নির্দিষ্ট নির্দেশনা পূর্বে থেকেই দিয়ে রাখা হয়। পরবর্তীতে কম্পিউটার নির্দেশনা অনুসরন করে দ্রুত সে অনুযায়ী আউটপুট দিতে সক্ষম। কম্পিউটারের দুটি মূল অংশ: হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার। কম্পিউটারের মধ্যে সকল কাজ সঠিকভাবে করতে সাহায্য করে সফটওয়্যার। আর হার্ডওয়্যার বলতে আমরা বুঝি বাইরে থেকে ধরা-ছোঁয়া যায় কম্পিউটারের এমন সকল যন্ত্রাংশকে।
কম্পিউটার যে শুধু ডাটা প্রসেস করে আউটপুট দেয় তাই নয়, আধুনিক কম্পিউটার ডাটা স্টোর বা সংরক্ষণ করে রাখতে পারে। কম্পিউটারে সঠিক ও নির্ভুলভাবে বিভিন্ন ডাটা প্রসেস করতে প্রোগ্রাম বা অ্যাপ্লিকেশন সাহায্য করে। এই প্রোগ্রাম বা এপ্লিকেশন হচ্ছে কম্পিউটারের নিজস্ব ভাষা (যাকে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ বলা হয় সে ভাষায় তৈরি) কম্পিউটারের জন্য নির্দেশনা। অর্থাৎ কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বুঝে নেয় যে তাকে কী কাজ করতে হবে। কম্পিউটারের ভাষা তৈরি হয় বাইনারী ডিজিট অর্থাৎ ০ এবং ১ এর মাধ্যমে।
কম্পিউটার উদ্ভাবনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
অ্যানালগ গণনাযন্ত্র মানবসভ্যতায় অনেক আগে থেকেই দেখা গেলেও প্রথম মেকানিক্যাল কম্পিউটার উদ্ভাবনের কৃতিত্ব দেয়া হয় চার্লস ব্যাবেজকে। তাকে কম্পিউটারের জনক বলেও আখ্যায়িত করা হয়। ১৮৩৭ সালে এই গণিতবিদ প্রথম এমন একটি ডিভাইস তৈরি করেন যেখানে ইনপুট দিয়ে আউটপুট পাওয়া যেত। পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে এই যন্ত্রে ইনপুট দেয়া যেত এবং বিভিন্ন গাণিতিক হিসাব করা যেত নির্ভুলভাবে। তিনি গণনা যন্ত্র ছাড়া একে আর কিছুই ভাবেন নি। অ্যাডা লাভেস নামক আরেক গণিতবিদ প্রথম বুঝতে পারেন গণনা ছাড়াও কম্পিউটারের পক্ষে আরও অনেক কাজ করা সম্ভব। ১৮৪৭ সালে তিনি এমন কিছু অ্যালগরিদম তৈরি করেন যার মাধ্যমে যন্ত্রটি নানা রকম কাজ করতে পারতো। তাই অ্যাডা লাভেসকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম প্রোগ্রামার।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যালান টুরিং নামের পলিশ এক গণিতবিদ আরেকটি যন্ত্র তৈরি করেন যার নাম দিয়েছিলেন তিনি ইউনিভার্সাল মেশিন। তিনি এই যন্ত্র ব্যবহার করতেন জার্মানদের এনক্রিপ্টেড মেসেজ ডিকোড করতে। টুরিংয়ের এই যন্ত্রকে বলা যায় প্রথম ডিজিটাল কম্পিউটার।
এরপর আইবিএম, মাইক্রোসফট, অ্যাপল সহ আরও অনেক বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কম্পিউটার আজকের পর্যায়ে এসেছে। কম্পিউটার পুরো পৃথিবীর চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।
কম্পিউটারে কী কী থাকে?
উপরে বলা হয়েছে কম্পিউটার মূলত দুটি অংশ নিয়ে গঠিত: সফটওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার। মূলত আমরা হার্ডওয়্যার অংশগুলোই বাইরে থেকে দেখতে পাই।
হার্ডওয়্যারের মধ্যে অনেক জিনিস থাকলেও সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু হার্ডওয়্যার হচ্ছে প্রসেসর, মেমোরি, মাদারবোর্ড, স্টোরেজ, বিভিন্ন ইনপুট ডিভাইস এবং বিভিন্ন আউটপুট ডিভাইস। প্রসেসর সকল ইনপুট ডাটা দ্রুত ও নির্ভুলভাবে প্রসেস করে ফেলতে পারে। মেমোরি ডাটা ট্রান্সফারের সময় এবং প্রসেসিংয়ের সময় সকল তথ্য সাময়িক সময়ের জন্য ধারণ করে রাখতে পারে। মাদারবোর্ড সকল পার্ট বা যন্ত্রাংশকে একসাথে সংযুক্ত করে। স্টোরেজ ডিভাইস সকল ডাটা সংরক্ষণ করে রাখতে পারে লম্বা সময়ের জন্য। যেমন: হার্ড ড্রাইভ, সলিড স্টেট ড্রাইভ ইত্যাদি। ইনপুট ডিভাইস কম্পিউটারে বিভিন্ন তথ্য ইনপুট দিতে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ কম্পিউটারকে সকল নির্দেশনা ইনপুট ডিভাইসগুলোর মাধ্যমে দেয়া হয়ে থাকে। যেমন; টাইপ করার কীবোর্ড, মাউস ইত্যাদি। আউটপুট ডিভাইস থেকে কম্পিউটারের প্রসেস করা ডাটা পাওয়া যায়। যেমন: সকল ডাটা দেখবার জন্য মনিটর।
সফটওয়্যার অংশে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের মাধ্যমে তৈরি করা নির্দেশনা বা অ্যাপ্লিকেশনগুলো রয়েছে। সফটওয়্যারকে বলা যায় কম্পিউটারের আত্মা। কম্পিউটার চালানোর জন্য অত্যাবশ্যকীয় অপারেটিং সিস্টেমও এক ধরনের সফটওয়্যার যা কোডিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া সফটওয়্যারের আরও উদাহরণ হলো ইন্টারনেট চালানোর ব্রাউজার: গুগল ক্রোম, ফায়ারফক্স ইত্যাদি। আপনার জন্য আরও: পুরাতন কম্পিউটার কেনার আগে যে বিষয়গুলো খেয়াল করবেন।
বিভিন্ন রকমের কম্পিউটার
এবার কাকে আমরা কম্পিউটার বলবো সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা নেয়া যাক। যে যন্ত্রে ইনপুটের মাধ্যমে আউটপুট পাওয়া যায় বিভিন্ন নির্দেশনা অনুযায়ী তাকেই কম্পিউটার বলা যায়। যেমন ক্যালকুলেটরকে আমরা সাধারণ গণনা যন্ত্র ভাবলেও এটি আসলে এক ধরনের কম্পিউটার। এছাড়া স্বাভাবিকভাবে আমরা কম্পিউটার বলতে ডেস্কটপ বা ল্যাপটপকে বুঝি। তবে ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ ছাড়াও কম্পিউটার আরও অনেক ধরনের হতে পারে। যেমন: মেইন ফ্রেম কম্পিউটার, সুপার কম্পিউটার, মাইক্রো কম্পিউটার, ওয়ার্কস্টেশন। সবধরনের কম্পিউটারই বিভিন্ন বিশেষ কাজে সুবিধা পেতে আলাদাভাবে ডিজাইন করা হয়। যেমন: ল্যাপটপ কম্পিউটারকে সহজে বহন করতে হালকা এবং পোর্টেবল করে তৈরি করা হয়।
এবার দেখে নেয়া যাক আরো কিছু ডিভাইসকে যারা মূলত কম্পিউটার। অনেক সময় আমরা এসব ডিভাইসকে কম্পিউটার বলে মনে করি না।
- মোবাইল ফোন: যে কোনো ধরনের মোবাইল ফোন আসলে ছোট আকারের কম্পিউটার। স্মার্টফোন বা ফিচার ফোন দুটোই বিশেষ কাজের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কম্পিউটার। সেই বিশেষ কাজ হচ্ছে যোগাযোগ। এখানে আমরা বিভিন্ন ডাটা ইনপুট দিয়ে আউটপুট পেয়ে থাকি। স্মার্টফোনের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আলাদা অংশ রয়েছে। অর্থাৎ যে কোনো ডিজিটাল ফোনই আসলে কম্পিউটার।
- ট্যাবলেট: স্মার্টফোনের মতো ট্যাবলেটগুলোও আসলে কম্পিউটার। আকারে কিছুটা বড় হলেও ট্যাবলেট মূলত বিভিন্ন ধরনের কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন: শিক্ষা, ডিজাইন ইত্যাদি।
- ডিজিটাল ওয়াচ: বিভিন্ন ডিজিটাল হাতঘড়ি আসলে কম্পিউটার। ডিজিটাল হাতঘড়িতে কমান্ডের মাধ্যমে আপনি ইনপুট দিতে পারেন। অ্যালার্ম সেট করা সহ আরো অনেক কাজ করা যায়। আধুনিক স্মার্টওয়াচ আরও জটিল বিভিন্ন কাজ করতে পারে। অর্থাৎ সময় দেখার জন্য বিশেষ এক কম্পিউটার ডিজিটাল ঘড়ি বা স্মার্টওয়াচ।
- স্মার্ট টিভি: ঘরে থাকা স্মার্ট টিভিগুলো আসলে কম্পিউটার। টিভি দেখতে বিশেষভাবে তৈরি করা হয় বলে এর কাজ মূলত টিভি বিষয়ক বিভিন্ন জটিল কাজ করে ফেলা।
এগুলো ছাড়াও আজকাল অনেক স্মার্ট ডিভাইস দেখা যায় যেখানে আপনি ইনপুটের মাধ্যমে নির্দেশনা প্রদান করে বিশেষ কোনো আউটপুট পেয়ে যান। এগুলো সকল কিছুই আসলে কম্পিউটার। এ সম্পর্কে আরও: ম্যাকবুক কী? অ্যাপলের ম্যাকবুক ল্যাপটপ এত জনপ্রিয় কেন?
অর্থাৎ আজকাল আমাদের আশেপাশে থাকা ডিজিটাল বিভিন্ন ডিভাইস প্রায় সবগুলোই আসলে কম্পিউটার। শুধুমাত্র বিশেষ কাজের জন্য আলাদাভাবে তৈরি করা হয়েছে বলে অনেকসময় আমরা তাকে কম্পিউটার ভাবি না। পিসি বা পার্সোনাল কম্পিউটারগুলো বিভিন্ন কাজ সম্পাদন করতে পারে বলে আমরা মূলত এদেরকেই আসলে কম্পিউটার বলে মনে করি। কিন্তু কম্পিউটার এখন আমাদের ডিজিটাল জগতের সকল জায়গাতেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
0 responses on "কম্পিউটার কী কম্পিউটার বিষয়ে জানুন"